Saturday, 6 July 2019



ভূত না ভুতের গপ্প
আজকাল আমাদের ছোটবেলার ভুতেদের মত, আর ভুতেদের গপ্প প্রায় শোনায় যায় না। আসলে আজকালকার বাচ্চাদের মধ্যে ভুতেদের নিয়ে কোন উৎসাহই নেই।  তাই, আজকাল ভুতেদের বাজার বড়ই খারাপ। ভুতরাও আর এত আলো এত শব্দ চারিদিকে এত দৌড়ঝাঁপ আর গন্ডগোলের মধ্যে নিজেদের রুপই নিতে পারে না। তাদেরও তো সাজগোজের জন্য একটা ড্রেসিং রুম চায়। একটু আধো আলো, একটু আধো অন্ধকার, এট্টুখানি ভালবাসা, একটুখানি রোমাঞ্চ, মানে গা ছমছম। না হলে ভুত বেচারী আসেই বা কি করে? তারও তো একটা উপযুক্ত মঞ্চ চাই। তার আসা তো আসা নয়... রীতিমতো আবির্ভাব।
আমার ছোটবেলা আর কিশোরকালের অনেকটাই কেটেছে রঘুনাথগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ আর লালবাগের আলো আঁধারী পরিবেশে। সেখানে যেমন ভালবাসা ছিল তেমনি ভালোবাসার মত ভুতেরাও ছিল। সেসব ভুতের গপ্প অনেক শুনেছি মার কাছে, ঠাকুরমার কাছে। গেছোভুত, মেছো ভুত, জমিদার ভুত, বেম্ভদত্যি কতকি। আমাদের জঙ্গীপুরের বাড়ীতেই একটা বেলগাছ ছিল। তাতে নাকি থাকত এক বেম্ভদত্যি।  আমার ঠাকুমা নাকি তাকে দেখেছিলেন একবার গাছ ছেড়ে আমাদের ছাদে এসে বসে থাকতে, ভারী দুখী মনে। এ আমার ঠাকুমার মুখে শোনা। তবে, সেসব ছিল ভারী মানুষঘেষা ভুত, কখনো কারুর ক্ষতি তো করেই নি বরং অনেকের উবগারেই এসেছেন বলে শুনে এসেছি। ছোটবেলায় ঠাকুমার কোলঘেষে অনেক ভুতের গল্পই শুনেছি। গা ছমছম করেছে  কিন্তু ভয় কি পেয়েছি? মোটেই না৷ বরং আজও যেটা মনে রয়ে গেছে সেটা ঠাকুরমার গায়ের ওম আর স্নেহ ভালোবাসা মিলে এক অদ্ভুত অনুভুতির অনুভব। যা আজও মিলিয়ে যায় নি। ভুত যদি বলেন সেটাও তো ভূত মানে আমাদের বিতে হুওয়া কাল।
তবে আমাদের কালে ভুতের অনেক উপাদানই ছিল। আমাদের কালে তো এত ত্রিফলা আর হাইমাস্ট চোখঝলসানো আলোর উপদ্রব ছিলনা। দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের ওপরে টিমটিমে বালব জলত। হয়ত নির্জন রাস্তায় কেরোসিন লম্ফ জালিয়ে এক আধটা রিক্সা টুংটুং করে হঠাৎ পাশ কাটিয়ে যাবে। সন্ধ্যের পর আলো অন্ধকারে সে এক ভারী রোমাঞ্চকর পরিবেশ।  আমার তো তাই মনে হত।  আর সেখানে যদি আপনি আপনার কল্পনার রশিকে একটু লাগামছাড়া হতে দেন, তাহলে তেনাদের সাক্ষাৎ হতেই হবে।

 সত্যি বলতে কি রঘুনাথগঞ্জ বা লালবাগে আমি অন্তত কোন ভুতেদের সাথে কোন এফেয়ার্সে জড়িয়ে পরিনি। অন্তত লালবাগে সে সম্ভাবনা তো ছিল বিস্তর। নবাব, বাদশাহ, হাতী ঘোড়া অস্ত্রের ঝনঝনানি, তোপের আওয়াজ, হত্যা, ষড়যন্ত্র,  সবই কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? এত অসুখী আত্মার অস্তিত্ব সব কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হয়ত না।  তবে আমার অনুভবে তারা আসেননি কেউই। তবে সাপের সাথে দেখা হয়েছে বিস্তর।  লালবাগে তোপখানায় রাস্তার উপর শুয়ে থাকা খরিস সাপের লেজের উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছি। ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পরেছিল ঠিকই কিন্তু ছোবল মারেনি। অবশ্য মারলে এই গপ্প শোনাতে আমার বদলে অন্য কেউ আসত। হাজারদুয়ারীর সামনের মাঠে আমাদের আড্ডার পেছনে এক ফণাধারী ফণা তুলে আমাদের রসালাপও শুনতে এসেছিলেন।  সময় মত আমরা সরে গিয়েছিলাম।  তাছাড়া এখানে ওখানে, ফুটো মসজিদের ফাটল থেকে তেনারাও আমাদের কুল কুড়োনোর সাক্ষী হয়েছিলেন।  চোখাচোখি হয়েছিল কিন্তু তেড়ে আসেন নি।
আমার ভুতের অভিজ্ঞতা বলুন বা যাই বলুন, সবই কিন্তু জিয়াগঞ্জের ভট্টপাড়ায়। জিয়াগঞ্জও কিন্তু অনেক পুরনো কালের শহর। বিরাট বিরাট বাড়ি।  সন্ধ্যের পর সে শহরও বড় ছায়াময়।
এবার শুনুন তবে গপ্প নয় হলফ করা সত্যি।
আমার পুরো শৈশবকালটা কেটেছে মুরশিদাবাদের জিয়াগঞ্জে। আমার প্রথম পাঠশালায় ভর্তি, ওখানেই, ভুজঙ্গ মাষ্টার মশায়ের পাঠশালায়। আমরা তখন ভাড়া থাকতাম, জিয়াগঞ্জের স্টীমারঘাটে হরিশবাবুর বাড়ীতে।পাড়ার লোকেরা তাকে ডাকত হরিশবুড়ো বলে। আমাদের কাছে অবশ্য তিনি ছিলেন হরিশ দাদু। আমার তখন পাঁচ, দাদুর বয়স ৭৫এর কমতো নয়ই। তো হরিশদাদু আর দিদিমা ছিলেন নিঃসন্তান। তাই আমার উপর তার স্নেহ ঝরে পরত অঝরধারে। বাড়ীর বাইরের ঘরে দাদু একটা ছোট মুদিখানার দোকান দিয়েছিলেন। তাতে অনেক লাল নীল লবেঞ্ছুসও থাকত। তার বেশ কিছু যে আমার পাওনা ছিল, সে কথা আর আলাদা করে বলার নয়। যাহোক, বাবা কিছুদিন পরে আমাকে পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু আমি কেঁদেকেটে একশা, কে আমাকে নিয়ে যাবে সেই পাঠশালায়। শেষে হরিশদাদু আমাকে দিয়ে এলেন, সঙ্গে দিলেন লবেঞ্ছুস পকেট ভর্তি করে। কিন্তু তাও আমার কান্না থামে না। বাড়ীর কাছেই পাঠশালা, দাদু মাঝে মধ্যেই আমাকে দেখে যেতেন। আর বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে বলতেন, রায়মশাই, নীলমনির কান্না এখন থেমেছে। এইরকম ছিল আমাদের সময়। কে আপন আর কে পর সে বোধই জন্মায়নি। সবাইকে নিজের লোক মনে হত। কেউ যেন পর নয়।পাড়াপ্রতিবেশী,তারা যত উঁচু মর্যাদার লোক হন না কেন, তারা সবাই খুব কাছের মানুষ ছিলেন।
আমার পাঠশালার পাঠও একদিন চুকল, আমি ভর্তি হলাম উঁচু ক্লাসে।এবার হল আমার পাড়াবদল। আমরা এবার এলাম জিয়াগঞ্জের আর এক প্রান্তে একটা বড় বাড়ীতে । পাড়ার নাম ভট্টপাড়া।ভট্টপাড়া বেশ পুরনো।অনেক বড়বড় বাড়ী। শ্রীপতসিইং দের বিশাল বিশাল প্রাসাদ, রাস্তার দুধারে।মফস্বল শহরে রাস্তার দুধারে তখন এত আলোর বাহার ছিলনা। অনেক দূরে দূরে একটা করে লাইট পোষ্ট থাকত আর তার অনেক ওপরে একটা টিমেটিমে বাল্ব জ্বলত।তার মধ্যে চারিদিকে বড় বড় প্রাসাদের ছায়ায় একটা আলোআন্ধকার গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি করত।ভুতদের জন্য আদর্শ পরিবেশ। তো আমাদের নতুন বাড়ীতেও ভুত ছিল। কিন্ত ভারী ভব্যসভ্য এক বিধবা মহিলা।আমরা দিদি,ভাইরা যে ঘরে শুতাম, সেই ঘরেই তিনি থাকতেন। আমাদের বিরক্ত করতেন না মোটেই। শুধু রাত্রে হঠাৎ , ঘুম ভেঙ্গে গেলে, তার বিলাপের শব্দ শোনা যেত। হয়ত তার পার্থিব জীবন তেমন সুখের ছিলনা, হয়ত কোন বঞ্ছনা ছিল, আশাভঙ্গ ছিল, যার রেশ তার মৃত্যুপরবর্তী জীবনেও থেকে গিয়েছিল। তার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ ভাবসাব না হলেও, অসদ্ভাব কোনদিন হয়নি।দিনের বেলাও তার দেখা পেয়েছি। আমরা ঘরে ঢুকলে , তিনি চট করে বেরিয়ে যেতেন।তার চলে যাবার সঙ্কেত আমরা বেশ বুঝতে পারতাম। একঝলক সাদা শাড়ীর ঝলক আমরা বহুদিন দেখেছি। অবশেষে একদিন জিয়াগঞ্জ থাকার মেয়াদ শেষ হল। বাবা বদলী হলেন অন্যত্র। শুধু মনে আছে, আমরা যেদিন মালপত্র নিয়ে গাড়ীতে উঠে চলে যাচ্ছি, সেদিন তাকে দেখেছিলাম আর একবার। এক সাদাশাড়ী অশরীরী দাঁড়িয়ে ছিলেন বাড়ীর গেটে। হয়ত, আমাদের বিদায় জানাবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন।দেখুন এ কথা লিখতে গিয়ে আমার চোখ জলে ভরে গেছে। তাকে যে আমরা ভালবেসে ফেলেছিলাম। আজ এই চোখের জলে মনে হল, সে ভালবাসা তো আজও মরেনি। হয়ত ভালবাসা মরেওনা কোনদিন।