Saturday, 11 May 2024

মামা ভাগ্নে কথা

 মামা ভাগ্নে


'নরানাং মাতুলক্রম' 

কথাটা শোনা শোনা লাগছে না? আরো আছে, 'বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা' 'মিষ্টান্ন মিতরে জনা'। সব শাস্ত্রবচন। আমি অতো শাস্তর বিশারদ নই। তবে কানে আসে। তাই দু'একটা কথা বলেও ফেলি। 

প্রথমেই বলে ফেলি, আমি মোটেই ততোটা বুড়ো নই, যতটা আমাকে দেখায়, তার থেকে মনে প্রাণে আমি ঢের ঢের নবীন। আর চলনে বলনেও প্রবীণ বা বুজর্গ এর ছাপ ততটা পরেনি যতটা পড়া উচিত ছিল। এর জন্যে ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট যদি কাউকেও দিতে হয়, সে সব আমার যোগাসনের  গুরুমশাইদেরই প্রাপ্য। আর ভার্যা মোটেই আর তরুণী নন। বরং যেদিন ধরণী তরুণী ছিল গোছের একটা ব্যাপার। এ ব্যাপারে বেশী কথা না বলাই নিরাপদ। 


সে সব কথা যাক। কথা হচ্ছিল মামা আর ভাগ্নের বিষয়ে।  ভাগ্নেরা মামার ছাঁচেই নাকি অনেকটা ঢালা। এ কথা কি সত্যি? ভাগ্নে যদি আপনার থাকে মিলিয়ে দেখুন তো একবার।  হয়তো আপনার বেলায় মিললেও মিলতে পারে।আমার তো বিন্দুমাত্র মেলেনি। শরসে পাওতক। আমাকে তো চেনেন। আমার চরিত্রও জানেন। অবশ্যি নিজের চরিত্তির নিয়ে ওতো ঢাঁক পেটাব না। কবে কোথায় কি বেড়িয়ে পড়ে, কে জানে। থাক বরং।  অতটা গব্ব না করাই ভালো।  

তবে মোটের উপর মানে মোটামুটি আরকি,আমি নির্ঝঞ্ঝাট টাইপের লোক। কোনকিছুতেই গা লাগাই না। ওই 'হচ্ছে হোক' জাতের মানুষ। কিছুতেই হেলদোল নেই। স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলা, এই হচ্ছে আমার কাজ। হাঁত পা ছুড়ে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা আমার বিলকুল নাপসন্দ। ওই স্রোতে গা লাগিয়েই তো বিপদে পড়েছিলাম। একবার নয় দুবার। জানমালের সলিল সমাধি আর কি। জঙ্গীপুরের ভরা গঙ্গা সাঁতার দিয়ে পার হতে গিয়ে একেবারে ভেসে গিয়েছিলাম।  ভাগ্যিস সতু ছিল। তাই চুলের মুঠি ধরে আর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পাড়ে টেনে এনেছিল। সতু ছিল বলেই আজও আমি রয়ে গেছি। আর আপনাদের আমার বকবকানি শুনতে হচ্ছে। সব ওই সতুর দোষ।  আমার কোন দায়ও নেই, দায়িত্বও নেই। যত দোষ ওই সতু ঘোষ। মাঝেমধ্যে সতুর কথা মনে পড়ে অবশ্য । হাজার হোক আমার জীবনদাতা।  কি জানি এখন কোথায় আছে বা নেই? তবে সতুরা সতুই থাকে সারাজীবন।  বিপদ দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ে কোনকিছুর পরোয়া না করেই।

ভাগ্নের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই এসে যাচ্ছে। আসলে ওর জীবনের অনেকটা জুড়েই আমি জড়িয়ে আছি। ঠিক প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, পরোক্ষ হলেও খুব নিবিড় ভাবে। ওর জন্ম আমাদের বাড়ীতে লালবাগেরই হাসপাতালে।  সেখানে দিদির রাতের খাবার দিতে গিয়ে খরিস সাপের সাথে মুখোমুখি মুলাকাত । ছোবল তুলে চোখে চোখ দিয়ে কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটেনবাবের ইয়ারদোস্ত জেনে, ছোবলটা আর দেয়নি। নবাবের দেশের সাপ তো, তাদের মর্জিমেজাজই আলাদা জাতের। সেই সাপটার কথাও আজকাল আমার মনে পড়ে। সতুর মতো সেও আমার জীবনদাতা। না হলে সেদিনও এক ছোবলেই ফুঁ হয়ে যেতাম। 

ভাগ্নের জন্ম হলো। ভাগ্নের পড়াশোনার এক অধ্যায়ও কেটেছে আমাদের কলকাতার বাড়ীতেই। ওর সেলে চাকরিরও এক অধ্যায়ের সাথে আমি জড়িয়ে আছি। আর ওর বিয়ে সেও আমার নিয়ে আসা সম্মন্ধ দিয়েই।


এইভাবে ভাগ্নের জীবনের সাথে পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা স্বত্বেও ওর সাথে আমার বেজায় অমিল। আমার মতো বেহিসেবী, বেআক্কেলী নয়। ভীষণ হিতাহিত জ্ঞান, ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন, হিসেবী পদক্ষেপ আজ ওকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের চূড়ায়। এতদিন সেল আর এনটিপিসিতে কাজ করে ও আজ ডিভিসির ডিরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে। আজ যাচ্ছি ওরই সানি পার্কের বাসায়। ডিনারের নেমন্তন্ন। 

জীবনের সব সাফল্যই আজ ওর করায়ত্ত।  কিন্তু বেচারী না জানলো বিড়ি ফোঁকার আনন্দ, না বুঝল এই আপ্তবাক্য  যে ' সাগর সে গেহরা যাম'।  না পেল মামার মতো স্রোতে ভেসে যাবার আনন্দ। আপাদমস্তক ভালো ছেলেই রয়ে গেল সারাজীবন। আসলে ওর জীবনে সতুর মতো বন্ধুরা আসেনি। আজ যদি আবার জীবনে আমার কিছু বেছে নেবার সুযোগ আসে, তবে আবার স্রোতে ভেসে যেতেই চাইব। চাইব সতুর মতো বন্ধুদেরই। রামকৃষ্ণদেবের মতই বলব, এই নাও মা তোমার পাপ, এই নাও তোমার পূণ্য আমায় আবার মহাকালের স্রোতে ভাসিয়ে দাও মা। এই নাও মা তোমার ভক্তি এই নাও তোমার অভক্তি , আমায় সতুর মতো বন্ধু আবার দিও মা।

Sunday, 5 May 2024

দীপক রাগ

 আমার ব্যাঙ্কওয়ালা বন্ধু, ভাই, বেরাদর দীপককে নিয়ে লেখা। আজকাল আর সেরকম যোগাযোগ নেই দীপকের সাথে। আসলে দীপক আলোর গতিতে এগিয়ে চলেছে, তার সাথে তালে তাল রাখা কার্যত না মুনকিন। পুরনো দিনের কথা স্মরণ করেই দীপককে সম্মান জানায় পুরনো লেখা দিয়েই।


আজ দীপকের সাথে বহুদিন পরে দেখা হল।



বোধহয় বছর পেরিয়ে গেছে। সেই রামধুরার পরে এই প্রথম।  আজ আমরা তিনমূর্তি ভাই বলরাম আর অগতির গতি,  দীনবন্ধু সুজিত গিয়েছিলাম দীপক সন্দর্শনে। দীপক যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে। সেইরকম গমগমে,ঝকঝকে প্রত্যয়ে অটল দীপক। বরঞ্চ আরও প্রত্যয়ী। সাধে কি আর ও প্রত্যয়ের প্রাণপুরুষ।  হাজারো লোক ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে আর থাকে ওর লেখার অপেক্ষায় ,  চায় ওর চলার পথের সঙ্গী হতে।  ভারী ভাল লাগল দীপককে দেখে, এ দীপক, দীপক রাগেও জ্বলল না, মেঘমল্লারেও ঝরে পরল না বরং দরবারি কানাড়ায় বেজে উঠল গমগম করে। তাতে বেজে উঠল আত্মপ্রত্যয় আর আগামীর আশ্বাস । আপনারা আশ্বস্ত থাকুন দীপক ভালো আছে, খুব ভাল আছে, নব আনন্দে আবার সে ফিরে আসছে আপনাদের মধ্যেই। দীপকের কাছেই দেখা মিলল স্বপন রায় বিশ্বাস আর গৌতমের ।  দুজনেই ভারী ভালমানুষ, ভালোবাসায় ভরা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তাই ওদেরই মত আপনার আমার সবার বিশ্বাস দীপক বিশ্বাসেই। জানি এমত বন্ধুভাগ্য যাদের তাদের জব্দ করবে কোন সে কোতোয়াল?


  আমরা তিন বন্ধু এসে জড়ো হলাম  কোন মাইখানায় নয়, ঢাকুরিয়া লেকের পাড়ে আর স্মরণ করলাম আরেক বন্ধু গালিবকে, গ্লাসের ঠুংঠাং আওয়াজে। শেষে কি হল? শেষ বলে কিছু  তো নেই। রবি ঠাকুর লিখে গেছেন না, "আমারে তুমি অশেষ করেছ....".


আর গালিব, তাকে কি দূরে রাখা যায়? 


৷   "হাজারো খোয়াসে এইসি কি হার খোয়াস পার দম নিকলে

৷৷   বহুত নিকলে মেরে আরমান,লেকিন ফির ভি কম নিকলে।"


বুঝলেন কিছু? দরকার নেই বোঝার। আনন্দে থাকুন।

Wednesday, 1 May 2024

ভুলোমন আর হাবিজাবি

 ভুলোমন আর হাবিজাবি 


 বেশী বয়সে লোকের ভুলভাল একটু আধটু হতেই পারে কিন্তু তা নিয়ে হইচই করা বোধহয় উচিৎ কাজ হবে না। চিরদিন  কাহারো সমান নাহি যায়। এ গান কে না শুনেছেন। তবে তার মধ্যেও কেউ কেউ কেন, অনেকেই আছেন যাদের মন ওই ভুলভুলাইয়ার ফাঁদে পরা বেচারীদের মত যারা বেরোবার রাস্তাটা আর খুঁজে পাননা হাজারো চেষ্টাতেও৷ ওই ইসে, আর কি যেনোতে আটকে থেকে হাঁসফাঁস করেন  অবিরাম যতক্ষণ না কেউ তাদের উদ্ধারে নামছেন। তো আমিও সেইরকম একজন ভুলোমন আম আদমি।  এইরকম কেন, বিচ্ছিরি রকমের ভুলোমন আমার। আমি আস্ত আস্ত লোককে একদম ভুলে যায়। আজ বলে না। আমার অল্প বয়েস থেকেই। কেউ হয়ত এসেছে পুরনো আলাপের সুবাদে আর আমি কিনা তাদের চিনতেই পারিনি।  কোনজন্মে তাদের দেখেছি বলেই মনে হয় না।তখন আমার বয়স কিন্তু মাত্র ত্রিশের কোঠায়। এটা কি কোন রোগ? হতেও পারে। তবে এর পরে অন্তত লোক চেনার ব্যাপারে সেইরকম গণ্ডগোলে আর পরতে হয়নি।  আমার অবশ্য একটা  গুণ আছে, রাস্তা ঘাট ভুলে গেলেও  আমি গন্ধ চেনায় খুব দড়। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক পৌঁছে যাব সঠিক গন্তব্যে। অনেকটা স্নির্ফার্স ডগের মত। ঠিক ওরা যেমন খুঁজে পেতে কোথায় লুকোনো ড্রাগ ঠিক বের করে ফেলে। আমি অবশ্য অত উঁচুদরের নয়। তবে শেখরের বাড়ি আমি ঠিক বের করে ফেলি। কষ্ট হয়না মোটেই  আর শেখর আমাদের গন্ধগোকুল।  ওর বাড়ির গন্ধই আমাকে টেনে নিয়ে যায়। এদিক ওদিক হয় না মোটেই,  কিসের গন্ধ সেটা না হয় উহ্যই থাক।


তবে ভুলোমন ব্যাপারটা আমাকে এখন আর সেইরকম জ্বালায় না। তবে ভারী দিকভ্রষ্ট লোকও আমি।  উত্তর দক্ষিণ, বাম ডান বোধ নেই একরকম৷ বেশীরভাগ সময়ই আমি উলটোপথে হাঁটি। সেদিন তো দেখলেন নাকতলা পোস্ট আফিসের বদলে আমি উলটোপথে হাঁটা লাগলাম।  তবে শুধরে নিই ঝটপট।  আর রাস্তাঘাটের মানুষ জনেরাও ভারী উপকারী৷ আমার ভুল বুঝতে পেরে তারা ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। তাই মানুষের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। সে আপনি ভার্চুয়াল বলুন আর যাই বলুন। আর বিশ্বাসের উপরই তো আমাদের জীবনের  অস্ত্বিত্ব দাড়িয়ে আছে, তাই না?  'জয় বাবা ফেলুনাথ' এর  ছোট্ট রুকুর মত যদি বলতে পারেন ' সব সত্যি, মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি আর ডাকু গন্ডারিয়াও সত্যি। সত্যকে মেনে নেওয়ার সাহস যদি থাকে তাহলেই জীবনে আনন্দ আপসেই চলে আসবে। কোন টেনশন থাকবে না বস।


তবে যাই বলি  আর তাই বলি এটাও তো ঠিক,  কিছু মানুষ নানা রোগভোগের শিকার হন তার মধ্যে আলঝাইমার্স, ডিমনেশিয়ার মত দুরারোগ্য রোগও আছে।  তাদের জন্য অবশ্য একটা টোটকা আছে। সেটা হল ঘুম থেকে উঠেই টাং টুইস্টিং গোছের একটা জিভের ব্যায়াম। জিভ দশবার ডান দিক দিয়ে ঘোরাতে হবে আর দশবার বা দিক দিয়ে। তাহলেই আপনি মুক্ত এই ডিমনিশিয়া বা আলঝাইমার্সএর শঙ্কা থেকে। শুধু তাই নয়, পূর্বজন্মের স্মৃতিও নাকি এসে হানা দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে,আমিও কয়েকদিন করেওছিলুম। কিন্তু সাতসকালে আয়নায় নিজেকে জিভ ভেঙাতে কার ভাল লাগে? তাছাড়া ভেবেও দেখলাম কি দরকার এ সবের। এই পড়ন্ত বেলায় সব কিছু আঁকড়ে ধরে কার কি লাভ। ভুলে যাবার মত ভাল ব্যাপার আর কিছু আছে নাকি? ' কা তব কান্তা, কস্ত্রে পুত্র' এটাতো জানেন আর মানেনও নিশ্চয় । কেউ কাউরির নয়, এ যে জীবনের মোক্ষম সত্য। তাই মন মিছে কর কেন প্রবঞ্চনা? আমি বলি কাজ কি এতসব ব্যায়ামের।  দরকার কি এতসব মনে রাখার।  আলঝাইমার্স না হোক ডিমনেশিয়া হয়ে সব ভুলে গেলেই বা  মন্দ কি । এখন এ সংসারে আপনি বাড়তি আসবাব ছাড়া, আর কিছু তো নন। 


তাই ভুল যান সবকুছ,

 তারপর বেরিয়ে পড়ুন এই মায়ার গন্ডী ফেলে। পেছন ফিরে যদি তাকান,তবে দেখবেন আপনার পেছন পেছন আসছে পাড়ার কটা ন্যাওটা কুকুর। ছেলে, বউ কেউ নয়। বড়রাস্তা পর্যন্ত পৌছে দেবে তারা আপনাকে। যদি কেউ থেকেও যায় আপনার সাথে তাহলে জানবেন  সে সাক্ষাৎ ধর্মরাজ, কুকুরের ছদ্মবেশে, আপনার এসকর্ট হয়ে চলবে একদম অমরাবতীর দোরগোড়া পর্যন্ত। তাই আজ থেকে যদিও ভুলেও যান কিছু, চিন্তা করবেন না, আরো বেশী করে ভুলুন। ভুলেই যান সবকিছু।তাহলে পাখোয়াজ বাজিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে আর গাইতে হবে না, ' শেষের সে দিন ভয়ংকর। '