মামা ভাগ্নে
'নরানাং মাতুলক্রম'
কথাটা শোনা শোনা লাগছে না? আরো আছে, 'বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা' 'মিষ্টান্ন মিতরে জনা'। সব শাস্ত্রবচন। আমি অতো শাস্তর বিশারদ নই। তবে কানে আসে। তাই দু'একটা কথা বলেও ফেলি।
প্রথমেই বলে ফেলি, আমি মোটেই ততোটা বুড়ো নই, যতটা আমাকে দেখায়, তার থেকে মনে প্রাণে আমি ঢের ঢের নবীন। আর চলনে বলনেও প্রবীণ বা বুজর্গ এর ছাপ ততটা পরেনি যতটা পড়া উচিত ছিল। এর জন্যে ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট যদি কাউকেও দিতে হয়, সে সব আমার যোগাসনের গুরুমশাইদেরই প্রাপ্য। আর ভার্যা মোটেই আর তরুণী নন। বরং যেদিন ধরণী তরুণী ছিল গোছের একটা ব্যাপার। এ ব্যাপারে বেশী কথা না বলাই নিরাপদ।
সে সব কথা যাক। কথা হচ্ছিল মামা আর ভাগ্নের বিষয়ে। ভাগ্নেরা মামার ছাঁচেই নাকি অনেকটা ঢালা। এ কথা কি সত্যি? ভাগ্নে যদি আপনার থাকে মিলিয়ে দেখুন তো একবার। হয়তো আপনার বেলায় মিললেও মিলতে পারে।আমার তো বিন্দুমাত্র মেলেনি। শরসে পাওতক। আমাকে তো চেনেন। আমার চরিত্রও জানেন। অবশ্যি নিজের চরিত্তির নিয়ে ওতো ঢাঁক পেটাব না। কবে কোথায় কি বেড়িয়ে পড়ে, কে জানে। থাক বরং। অতটা গব্ব না করাই ভালো।
তবে মোটের উপর মানে মোটামুটি আরকি,আমি নির্ঝঞ্ঝাট টাইপের লোক। কোনকিছুতেই গা লাগাই না। ওই 'হচ্ছে হোক' জাতের মানুষ। কিছুতেই হেলদোল নেই। স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলা, এই হচ্ছে আমার কাজ। হাঁত পা ছুড়ে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা আমার বিলকুল নাপসন্দ। ওই স্রোতে গা লাগিয়েই তো বিপদে পড়েছিলাম। একবার নয় দুবার। জানমালের সলিল সমাধি আর কি। জঙ্গীপুরের ভরা গঙ্গা সাঁতার দিয়ে পার হতে গিয়ে একেবারে ভেসে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস সতু ছিল। তাই চুলের মুঠি ধরে আর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পাড়ে টেনে এনেছিল। সতু ছিল বলেই আজও আমি রয়ে গেছি। আর আপনাদের আমার বকবকানি শুনতে হচ্ছে। সব ওই সতুর দোষ। আমার কোন দায়ও নেই, দায়িত্বও নেই। যত দোষ ওই সতু ঘোষ। মাঝেমধ্যে সতুর কথা মনে পড়ে অবশ্য । হাজার হোক আমার জীবনদাতা। কি জানি এখন কোথায় আছে বা নেই? তবে সতুরা সতুই থাকে সারাজীবন। বিপদ দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ে কোনকিছুর পরোয়া না করেই।
ভাগ্নের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই এসে যাচ্ছে। আসলে ওর জীবনের অনেকটা জুড়েই আমি জড়িয়ে আছি। ঠিক প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, পরোক্ষ হলেও খুব নিবিড় ভাবে। ওর জন্ম আমাদের বাড়ীতে লালবাগেরই হাসপাতালে। সেখানে দিদির রাতের খাবার দিতে গিয়ে খরিস সাপের সাথে মুখোমুখি মুলাকাত । ছোবল তুলে চোখে চোখ দিয়ে কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটেনবাবের ইয়ারদোস্ত জেনে, ছোবলটা আর দেয়নি। নবাবের দেশের সাপ তো, তাদের মর্জিমেজাজই আলাদা জাতের। সেই সাপটার কথাও আজকাল আমার মনে পড়ে। সতুর মতো সেও আমার জীবনদাতা। না হলে সেদিনও এক ছোবলেই ফুঁ হয়ে যেতাম।
ভাগ্নের জন্ম হলো। ভাগ্নের পড়াশোনার এক অধ্যায়ও কেটেছে আমাদের কলকাতার বাড়ীতেই। ওর সেলে চাকরিরও এক অধ্যায়ের সাথে আমি জড়িয়ে আছি। আর ওর বিয়ে সেও আমার নিয়ে আসা সম্মন্ধ দিয়েই।
এইভাবে ভাগ্নের জীবনের সাথে পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা স্বত্বেও ওর সাথে আমার বেজায় অমিল। আমার মতো বেহিসেবী, বেআক্কেলী নয়। ভীষণ হিতাহিত জ্ঞান, ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন, হিসেবী পদক্ষেপ আজ ওকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের চূড়ায়। এতদিন সেল আর এনটিপিসিতে কাজ করে ও আজ ডিভিসির ডিরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে। আজ যাচ্ছি ওরই সানি পার্কের বাসায়। ডিনারের নেমন্তন্ন।
জীবনের সব সাফল্যই আজ ওর করায়ত্ত। কিন্তু বেচারী না জানলো বিড়ি ফোঁকার আনন্দ, না বুঝল এই আপ্তবাক্য যে ' সাগর সে গেহরা যাম'। না পেল মামার মতো স্রোতে ভেসে যাবার আনন্দ। আপাদমস্তক ভালো ছেলেই রয়ে গেল সারাজীবন। আসলে ওর জীবনে সতুর মতো বন্ধুরা আসেনি। আজ যদি আবার জীবনে আমার কিছু বেছে নেবার সুযোগ আসে, তবে আবার স্রোতে ভেসে যেতেই চাইব। চাইব সতুর মতো বন্ধুদেরই। রামকৃষ্ণদেবের মতই বলব, এই নাও মা তোমার পাপ, এই নাও তোমার পূণ্য আমায় আবার মহাকালের স্রোতে ভাসিয়ে দাও মা। এই নাও মা তোমার ভক্তি এই নাও তোমার অভক্তি , আমায় সতুর মতো বন্ধু আবার দিও মা।

