Sunday, 27 October 2019

পন্ডিত উবাচ

এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলুম,বলুন তো কোন জায়গাটা আপনাদের সবচেয়ে প্রিয়। যদি ফিরে যেতে চান  কোথায় যাবেন? আমি নিশ্চিত  আপনারা শতকরা  ১০০ জনই চাইবেন আবার স্কুল জীবনে ফিরে যেতে। কারন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তার স্কুল জীবনই আর জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুরা সব স্কুল জীবনের চৌহদ্দির মধ্যেই রয়ে গেছে।

আমার স্কুল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় গেছে, লালবাগের নবাব বাহাদুর  স্কুলের বিশাল গন্ডীর মধ্যে। আমরা সেখানে যেমন সাধারন ঘরের ছেলেরা ছিলুন তেমনি আমাদের বন্ধুরাও ছিল সব একদা নবাব উজীরের ছেলে। কত নাম করব, জামা নবাব, পাপ্পু নবাব,আলিবান,খাস মীরজাফরের উত্তরপুরুষ।  এখনও ওদের পুরনো বাড়ী নেমকখারাম দেউরির কাছেই। এর মধ্যে পাপ্পু ছিল সবথেকে বদ। সব অসভ্য অসভ্য ছড়ার বিরাট ভান্ডার ছিল ওর কাছে। তার থেকে একটাও যদি আপনাদের এখন শোনাতে যায়, ফেসবুক আমাকে নির্বাসন দেবে চিরদিনের মত। বেশ মজা করে স্বপ্নের মত দিন কাটত তখন।

আজও আমি ফিরে ফিরেই লালবাগে যায়। পুরনো বন্ধুরা অনেকেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু জামা নবাব যে এখন ছোটে নবাব মুর্শিদাবাদের একইরকম রয়ে গেছে। দিলদার, রংবাহারি। ওর সাথে দেখা হলেই ছোটবেলাটা যেন হুড়মুড়িয়ে ফিরে আসে।
  স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু ছিল অপু আর পন্ডিত। অপু শ্যামল আর উজ্জ্বল আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ।  অপুকে নিয়ে অনেকে গল্প আছে সে এখন বলা যাবে না। তারথেকে বরং ছোট্ট একটা গল্প নয় বরং ছোট্ট ঘটনা শুনুন। আমরা তখন লালবাগের সাহানগরে থাকতুম,কুঞ্জবুড়ীর বাড়িতে। আর পন্ডিতদের বাড়ী ছিল ঠিক আমাদের পেছনেই। আর আমাদের সামনেই থাকত তুতুন। ভারী ডাটিয়াল মেয়ে। বেণী দুলিয়ে গটমট করে হেটে যেত আমাদের সামনে দিয়ে। পাত্তাই দিত না। তবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ সবটাই যে ওর পথের পানে উদগ্রীব হয়ে থাকত,সেকি আর বলার কথা? আমাদের পন্ডিতও কিছু কম ছিলনা।  মেধাবী,রূপবান।  ওর বড্ড বেশি ক্রাশ ছিল (বাংলায় কি যেন বলে মোহগ্রস্ত হয়ত)  তুতুনের উপর।আমরা বন্ধুরা মিলে বন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে এলুম। ঠিক হল তুতুনকে চিঠি দেবে পন্ডিত। আশা যাবার পথে তুতুনের হাতে ধরিয়ে দেবে ওর আত্মসমর্পণের জবানবন্দী।  তো সে চিঠি সব কাঁচা মাথার মিলিত উদ্যোগে লেখা হল।  মতিঝিলের মসজিদের  এক ঘরের ছাদে বসে। ওখানে তখন লোকজন কম যেত। পন্ডিতের হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর।  ক্যালিগ্রাফির অলংকরণে লেখা হল প্রেমিক হৃদয়ের জবানবন্দি।  সেই চিঠি পকেটে নিয়ে পণ্ডিত উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে থাকত তুতুনের আশা যাবার পথে। সাহসে আর কুলোত না।

তারপর কি হল আমি ঠিক জানিনা।  কেউ বলে পন্ডিত চিঠিও দেবার আগেই তুতুনের হাত ধরে চুমু খেয়ে ছিল। তার উত্তর  এসেছিল চড়ে। আমরা অবশ্য বিশ্বেস করিনি একেবারেই।  বিশেষ করে চুমুখাবার কথাটা। কারন আমাদের মনেও এমন গোপন বাসনাই যে ছিল। তবে এরপরে কিছুদিন ওর টিকিটাও দেখিনি।

এ কাহিনির শেষটা একটু ট্রাজিকই। পন্ডিত ওর বাবা মারা যাবার পর  চলে গিয়েছিল কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ায়,মামার বাড়ি।  ঘটনাচক্রে, তুতুনের বিয়েও হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। দেখা হয়েছিল কোন এক শাড়ির দোকানে কোনদিন।  তুতুন বড়াবড়ই বড় সপ্রতিভ।  পন্ডিতের কোলে ওর ছেলেকে তুলে দিয়ে বলেছিল ' এই তোমার পন্ডিত মামা' আর নিজে শাড়ি পছন্দে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

বেচারি পন্ডিত!!!!
লালপরী,নীলপরী আর বাখরখানি বিস্কুট

লালবাগ যারা গেছেন, তারা নিশ্চয়ই পাঁচরাহার মোড় চেনেন। পাঁচরাহা কি নিশ্চয়ই বুঝেছেন। পাঁচ রাস্তার মোড়। এক রাহা চলে গেল ভাগীরথীর পানে যেখানে থাকত ছোটখাটো চেহারার জ্যোতিকণা। ভারী সুন্দর, বিষন্নও যেন। হটাৎ ওর মুখটা ভেসে উঠল মনের কোনে। ভারী দুঃখী মেয়ে। আর এর একদিকে কেল্লা নিজামত।  যার দক্ষিণ দরজা পেরিয়েই আমাদের রাজত্ব। আমাদের আড্ডার জায়গা, রোমান গথিক স্টাইলের প্রাচীরের গায়ে গঙ্গার ধার ঘেষে আমাদের আড্ডা। সামনে সুমহান হাজারদুয়ারী।  সেছিল এক স্বপ্নের দিন। রইল বাকী তিন রাহা। একদিক গেছে হাতীশাল। আর একদিকে বিরাট আস্তাবল। আজ আর ঘোড়া নেই। দোকানে দোকানে ভরে আছে। আর একদিক গেছে খাগড়ার দিকে, মাঝে মহারাজ নন্দকুমারের বাড়ী, কাশিমবাজারের মহারাজের বাড়ী পেরিয়ে বহরমপুর শহর। যেখানে আমরা হরহামেশাই সাইকেল চালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। আশা পারেখের সিনেমা। আমাদের কালের বুক ঢিপঢিপ করা হিরোইন। তার ছলছলে চোখ আমাদের বুকে উথালপাতাল ঝড় তুলে যেত। আর সন্ধ্যেবেলা গাছমছম অন্ধকারের মধ্যে বটপাকুড়ের অন্ধকার ছায়া পেরিয়ে ফিরে আসতাম এই ছোট্ট শহরেই। পাঁচরাহা, এই ছোট্ট ঐতিহাসিক শহরেরই প্রাণকেন্দ্র। ছোট্টই বা বলি কি করে? এককালে বাংলা,বিহার, ওড়িশার রাজধানী। কম কথা তো নয়। সেকালের লন্ডনের থেকেও জাঁকে জমকে ভারী ওজনদার শহর। আজও তো তার কিছু চিহ্ন রয়েই গেছে। নবাব,বাদশাহ, হাতীশালে হাতী, আস্তাবলে সব বড় বড় ঘোড়া, এসব তো আমরাই দেখেছি। তবে নবাব আমাদের কালে হয়ে রইল ছোটে নবাব। আমাদের এক ক্লাসের বন্ধু। রাজত্ব হারিয়ে সেও মিশে গেল আমজনতার মাঝে। মতিঝিলের মসজিদের পাশের আমবাগানের ডালে বসে বিড়ি ফোঁকা ছোটে নবাব আমাদের মত পাত্র মিত্র অমাত্যদের সাথে,রাজকার্য ভুলে মশগুল হয়ে আড্ডায় মেতে রইত।

পাঁচরাহার দোকান, হাটবাজার বাস স্টপ, নবাবের আস্তাবল, হাতীশাল। কুঁড়াদার সেলুন, ঝুমুর চপের দোকান, অমল মোদকের মিষ্টির দোকান, নীরোদবাবুর বেকারি,জামাইয়ের মিষ্টির দোকান, আজ হয়ত আর নেই।  রয়ে গেছে স্মৃতিতে।  ইতিহাস আর বর্তমানে হাত ধরাধরি করে চলা এক ভারী মনখারাপের জায়গা। কেল্লায় আড্ডা ফেরত আমরা জামাইয়ের মিষ্টির দোকানের ধাপিতে বসতাম কিছুটা সময়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন যাবে লালপরী আর নীলপরির দল । এরা সব লালবাগের সেরা সুন্দরীদের ঝাঁক। পৃথিবীর সেরা সুন্দরী সব। আমাদের সামনে দিয়ে সদর্পে বেড়িয়ে যেত। আড়চোখে দেখত অবশ্যই। সেটাই ছিল তখন বিরাট প্রাপ্তি। আর ছিল বেকারির গরম গরম বাখরখানি। তার তুল্য স্বাদ আর কোথাও  পাইনি। আসলে কৈশোরের স্বাদ কি আর ফিরে পাওয়া যায়?
এটা কোন গপ্প নই,স্মৃতিকথা তো নয়ই। আজ জ্বরের ঘোরে আধেক ঘুমে আধেক জাগরণে এসে ফিরে গেল লালপরী আর নীলপরীদের দল। বাখরখানির স্বাদ এখনো যে মুখে লেগে আছে। সে-তো মিথ্যে নয়। এসেছিল তারা, ফিরেও গেল। কোথায় কে জানে?