Sunday, 27 October 2019

লালপরী,নীলপরী আর বাখরখানি বিস্কুট

লালবাগ যারা গেছেন, তারা নিশ্চয়ই পাঁচরাহার মোড় চেনেন। পাঁচরাহা কি নিশ্চয়ই বুঝেছেন। পাঁচ রাস্তার মোড়। এক রাহা চলে গেল ভাগীরথীর পানে যেখানে থাকত ছোটখাটো চেহারার জ্যোতিকণা। ভারী সুন্দর, বিষন্নও যেন। হটাৎ ওর মুখটা ভেসে উঠল মনের কোনে। ভারী দুঃখী মেয়ে। আর এর একদিকে কেল্লা নিজামত।  যার দক্ষিণ দরজা পেরিয়েই আমাদের রাজত্ব। আমাদের আড্ডার জায়গা, রোমান গথিক স্টাইলের প্রাচীরের গায়ে গঙ্গার ধার ঘেষে আমাদের আড্ডা। সামনে সুমহান হাজারদুয়ারী।  সেছিল এক স্বপ্নের দিন। রইল বাকী তিন রাহা। একদিক গেছে হাতীশাল। আর একদিকে বিরাট আস্তাবল। আজ আর ঘোড়া নেই। দোকানে দোকানে ভরে আছে। আর একদিক গেছে খাগড়ার দিকে, মাঝে মহারাজ নন্দকুমারের বাড়ী, কাশিমবাজারের মহারাজের বাড়ী পেরিয়ে বহরমপুর শহর। যেখানে আমরা হরহামেশাই সাইকেল চালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। আশা পারেখের সিনেমা। আমাদের কালের বুক ঢিপঢিপ করা হিরোইন। তার ছলছলে চোখ আমাদের বুকে উথালপাতাল ঝড় তুলে যেত। আর সন্ধ্যেবেলা গাছমছম অন্ধকারের মধ্যে বটপাকুড়ের অন্ধকার ছায়া পেরিয়ে ফিরে আসতাম এই ছোট্ট শহরেই। পাঁচরাহা, এই ছোট্ট ঐতিহাসিক শহরেরই প্রাণকেন্দ্র। ছোট্টই বা বলি কি করে? এককালে বাংলা,বিহার, ওড়িশার রাজধানী। কম কথা তো নয়। সেকালের লন্ডনের থেকেও জাঁকে জমকে ভারী ওজনদার শহর। আজও তো তার কিছু চিহ্ন রয়েই গেছে। নবাব,বাদশাহ, হাতীশালে হাতী, আস্তাবলে সব বড় বড় ঘোড়া, এসব তো আমরাই দেখেছি। তবে নবাব আমাদের কালে হয়ে রইল ছোটে নবাব। আমাদের এক ক্লাসের বন্ধু। রাজত্ব হারিয়ে সেও মিশে গেল আমজনতার মাঝে। মতিঝিলের মসজিদের পাশের আমবাগানের ডালে বসে বিড়ি ফোঁকা ছোটে নবাব আমাদের মত পাত্র মিত্র অমাত্যদের সাথে,রাজকার্য ভুলে মশগুল হয়ে আড্ডায় মেতে রইত।

পাঁচরাহার দোকান, হাটবাজার বাস স্টপ, নবাবের আস্তাবল, হাতীশাল। কুঁড়াদার সেলুন, ঝুমুর চপের দোকান, অমল মোদকের মিষ্টির দোকান, নীরোদবাবুর বেকারি,জামাইয়ের মিষ্টির দোকান, আজ হয়ত আর নেই।  রয়ে গেছে স্মৃতিতে।  ইতিহাস আর বর্তমানে হাত ধরাধরি করে চলা এক ভারী মনখারাপের জায়গা। কেল্লায় আড্ডা ফেরত আমরা জামাইয়ের মিষ্টির দোকানের ধাপিতে বসতাম কিছুটা সময়। অপেক্ষায় থাকতাম কখন যাবে লালপরী আর নীলপরির দল । এরা সব লালবাগের সেরা সুন্দরীদের ঝাঁক। পৃথিবীর সেরা সুন্দরী সব। আমাদের সামনে দিয়ে সদর্পে বেড়িয়ে যেত। আড়চোখে দেখত অবশ্যই। সেটাই ছিল তখন বিরাট প্রাপ্তি। আর ছিল বেকারির গরম গরম বাখরখানি। তার তুল্য স্বাদ আর কোথাও  পাইনি। আসলে কৈশোরের স্বাদ কি আর ফিরে পাওয়া যায়?
এটা কোন গপ্প নই,স্মৃতিকথা তো নয়ই। আজ জ্বরের ঘোরে আধেক ঘুমে আধেক জাগরণে এসে ফিরে গেল লালপরী আর নীলপরীদের দল। বাখরখানির স্বাদ এখনো যে মুখে লেগে আছে। সে-তো মিথ্যে নয়। এসেছিল তারা, ফিরেও গেল। কোথায় কে জানে?

No comments:

Post a Comment