Friday, 21 February 2025

জিলিপি আর চায়ে গরম




লাভা থেকে সুন্দর সুন্দর তিনটে কফি মগ নিয়ে এসেছি। দুটো আমার দুই নাতি নাতনির। আর একটা আমার৷ নাতি নাতনি পছন্দ করে লাল আর নীল রঙের দুটো নিয়ে নিয়েছে। আর এই হলুদ মাগ টা আমার।  সকালের চা টা আমি বেশ আয়েশ করে খাই। ঘুমের পরে বেশ বিশ্রামের মতন। আগেকার জমিদার বাবুদের মতন। তামুকে গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ তুলে অধো নিমীলিত চোখে। আর হবে নাই বা কেন। আমাদের দাদু ঠাকুর্দারাও একসময় জমিদারই তো ছিলেন, ঢুলিপাহাড়ী আর কাঞ্চনতলার । সে যাকগে,  সেসব গেছে চুকেবুকে। তবে স্বভাবটা রয়ে গেছে মৌজ করে চা খাওয়ার। এক মাগ ভর্তি সবুজ সবুজ চা৷ আর সঙ্গে অবশ্যই জিলিপি। জিলিপির কোন বিকল্প হয় নাকি? জিলিপির বিকল্প উন্নততর জিলিপি। আজ যেমন খাচ্ছি। প্যাঁচে প্যাঁচে রস। হচ্ছিল কফি মাগের কথা। জিলিপি এসে দিকভ্রষ্ট করে দিয়ে গেল। 


মাগটা তো দেখলেন।  সুন্দর না। মাত্র ২৫০ টাকা দাম। ঢাকনিতে সুন্দর আয়না লাগানো।  ইচ্ছে করলে চা খেতে খেতে নিজের মুখও দেখে নিতে পারেন। আমিও চেষ্টা করেছিলুম দেখতে। কিন্তু যতবারই দেখি, এক বুড়ো শেয়ালের মুখ ভেসে ওঠে। ছি ছি অশোক রায়, তোমার এতো অধঃপতন?  সত্যিই তো বাঘ যখন হতে পারিনি, শেয়াল ছাড়া আর কিই বা হতে পারি? আপনারা একটু কনফার্ম করবেন তো, আমাকে  কি সত্যি সত্যিই শেয়াল শেয়াল দেখতে?

Friday, 14 February 2025

হলং

 কাল ছিল আমাদের ডুয়ার্স সফরের দ্বিতীয় দিন। এর আগে জলপাইগুড়িতে কোনদিন রাত্রিবাস করিনি। এবারও সে অপূর্ণতাও পূর্ণ হয়ে গেল। কারণ এবার নিউজলপাইগুড়ি থেকে আমাদের যাত্রার ট্রেন খুব সকালে। রাত্রিবাস জরুরী ছিল। স্টেষনের কাছেই হোটেল। ঝকঝকে  হোটেল। ননী কোন অপূর্ণতা রাখে নি। ওই রাত্রে তরুণ যখন চিতল মাছের পেটি খোঁজে, তখন বুঝে নিন, আথিতেয়তার কোন পর্য্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। 


সে সব যাই হোক, ওই সকালে সবাই স্নান সেরে আলুর পরোটা প্যাকেট নিয়ে উঠলুম ট্যুরিস্ট স্পেশাল ভিস্তাডোমে। চারিদিকে কাঁচ ঘেরা ট্রেন। ভিস্তাডোম। ভারী সুন্দর।  ছবি দিয়েছি কয়েকটা দেখবেন। বেশ লাগে এসব ট্রেনে সফর করতে। ট্রেন লাইনের দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে। সেই নিশ্চিন্তপুরের অপু, দুর্গারও ভালো লাগতো।  আমরা যারা এই যুগের, কেউ কেউ যারা আজো অপু রয়ে গেছি, তারাও আজো জানালার ধারে বসে এই ডুয়ার্সের নদী পাহাড় অরণ্য আজও অবাক বিস্ময়ে দেখেই চলে। অপুরা চিরকালই পৃথিবীতে রয়ে যায়। একসময় এই ভিস্তাডোম সফর শেষ হল। ট্রেন যেন তাজগী ঘোড়ার সওয়ার করে নিমেষে পৌঁছে দিল, মাদারীহাট স্টেশনে৷ মাদারীহাট, হলংএ ঢোকার সিংহদ্বারই বলা যায়।এবার তিনদনের মৌরসীপাট্টা আমাদের এই হলং ইকো রিসোর্টেই। কটেজ টাইপের বাড়ী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।  আমাদের গুলতানি মারার আদর্শ জায়গা। তবে আমাদের কটেজের মালিক বিশ্বনাথদা৷ বিশ্বনাথবাবুর পরিচয় যদি এককথায় দিতেই হয়৷ তবে তার পরিচয় প্রেমিক আর বিপ্লবী।  বিপ্লব করতে করতে প্রেম। বিপ্লবের সর্বনাশ। প্রেমের জয়। আর কেই বা না চায় প্রেমের জয়, বলুন? আমিও তাই। আপনিও নিশ্চয় দলছাড়া হতে চাইবেন না৷ 


এক সময়ের নকশাল। সেই স্কুলের দশম ক্লাস থেকেই, গলায় ইন্টারন্যাশনাল, আর রবীন্দ্রনাথের, 'ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, মোদের বাঁধন ততই টুটবে" গলায় নিয়ে মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প। সেসব ছিল একদিন। তবে বিপ্লবের বারুঁদে ভেজাল ছিল। বেশীওপরে উঠতে পারেনি। কমদামি হাওয়াইয়ের মতো পপাতধরণীতলে হতে সময় লাগেনি মোটেই। আর প্রেমও তো ছিল অনেক। মঞ্জু,ডলি, মলি, জ্যোতিকণার দল। সবাই কিন্তু রুপসী কন্যা। প্রেমটা একতরফাই ছিল৷ মুখফুটে বলা হয়নিকো আর৷ বিপ্লব, প্রেম সবই শেষ।  এবার ফিরে আসুন জলদাপাড়ায়। শিং বেঁকানো গন্ডারের আড্ডায়৷ এখানে প্রেমের প্রবেশ নিষেধ।  বেশী ট্যাঁফোঁ করলে, গণ্ডারের গুতোয় এফোঁড ওফোঁড় হয়ে যাবার শঙ্কা৷ 

আপাতত প্রেমে ইতি দিয়ে চলুন, জঙ্গলে যাই। বন্যেরা বনে সুন্দরের খোঁজে। 


হলং রিসার্ভ ফরেস্ট৷ ১৮ জনের দল৷ মহিলাও বেশ কয়েকজন আছেন। ক্যাচোর ম্যাচর চলছেই সারাক্ষণ।  এদের নিয়েই জঙ্গলে।  হলংএ ননীর সাথে আগেও এসেছি। সেবার কপালে এক ভারী গরীব ধরণের গণ্ডার ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। তবে এবার ননীর কপাল একেবারে তুঙ্গে বৃহস্পতি।  জন্তু জানোয়ার আর পাখী, ময়ুরের মেলা। একটা দুটো নয়৷ দলে দলে আর পালে পালে৷ আর ময়ুরেরা  তো সারাক্ষণ পেখম মেলে আমাদের মনোরঞ্জন করেই চলল। বিশালাকায় হাতীর দল, ষণ্ডামার্কা সব শিং বেঁকানো শম্বরের দল, দৈতাকায় সব বাইসন বা গৌড়, যাই বলুন। দারুণ জমজমাট এক জাঙ্গল সাফারি হলো। 


কিন্তু আসল আড্ডা তো হবে ভর সন্ধ্যে বেলায়। হাম তুম আর ব্যাগপাইপার। ও কিছু নয়। একটু ক্যাটালিটিক এজেন্ট মাত্র৷ দু এক পেগ পেটে পড়লেই সব এক একজন আঁতেল মার্কা হয়ে ওঠেন। আর এই আড্ডাটার জন্যেই আমরা বারবার ফিরে আসি ননীগোপালের দলে। দুতিনঘন্টা নিমেষে কেটে যায়। ফরাসী বিপ্লব, নাজিম হিকমত, চে গুয়েভারা, সত্যজিত, সুনীল শক্তি আরো সব নামী অনামী হস্তীদের চুলচেরা বিশ্লেষণে৷ দারুণ জমজমাট আড্ডা। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললেও আড্ডা থামতে চায় না৷ দুপেগ তিনপেগের পড়ে আবার শুরু হয় অনুরোধের আসর। অনারের খেলা তখন৷ এ খেলা ননীর তৈরি আমরা তখন একে অন্যকে সম্মান জানায়,  খাদা দিয়ে নয় পেগ দিয়ে। এ খেলাও একসময়ে থেমে যায়। খালাসীটোলার আলোও  নিভে যায়। 

"তখন থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। "

অথবা

" ভ্রুপল্লবে যদি ডাক দিয়ে থাক, 

চন্দনবনে দেখা হতে পারে।"

আপনারাও আসুন। 

আজ আমরা বনে নয়, সবাই মিলে যাব চন্দনবনে।


ছবি ঃ সৌজনেঃ ননীগোপাল।