ইচ্ছে ভ্রমণ
রবি ঠাকুর কবেই লিখে গেছেন:
আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে,
দৈবে হতেম দশম রত্ন, নবরত্নের কালে,
একটি শ্লোকে স্তুতি গেয়ে, রাজার কাছে নিতেম চেয়ে,
উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে কানন ঘেরা বাড়ী,
রেবার তটে চাঁপার তলে, সভা বসত সন্ধ্যা হলে,
খেলার ছলে আপন মনে, দিতাম কন্ঠ ছাড়ি।
জীবনতরী বয়ে যেত, মন্দাক্রান্তা তালে,
আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে।
উজ্জয়িনী আমারও খুব প্রিয় জায়গা। শিপ্রা নদীতীরে বসে, শকুন্তলা না হোক, লিখতে তো পারতাম,
' যাও পাখী বলো তারে, সে যেন ডাকে না মোরে।'
তবে আজকে আমার পছন্দের তালিকায় উজ্জয়িনী নয়, প্রাচীন গ্রীস। সময়ের দুরত্বে, পথের দুরত্বে সে যে উজ্জয়িনীর থেকেও যোজন যোজন দূর।
আজকে আমার গন্তব্য প্রাচীন গ্রীসের পাহাড় ঘেরা শহর এথেন্স। রোমান সভ্যতায় এথেন্স আর স্পার্টার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আজ আমি বেছে নেব এথেন্সকেই। কারণ এখানেই আমার শিক্ষক, সে সময়ের শ্রেষ্ট শিক্ষক, সক্রেটিসের বাস। আমি তারই শিষ্য। কে আমি? আমি ক্রিটো। সক্রেটিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুই বলতে পার। আর সেই সময়কাল কিন্তু আজ নয়, খ্রীষ্টপূর্ব পুর্ব প্রায় পাঁচশ বছর আগে। ধরাই যায় প্রায় তিনহাজার বছর আগে। সেদিনের সেই ক্রিটো, এই আজকের আমি। কত তফাৎ না? সেদিনের সেই ক্রিটো, সক্রেটিসের ছায়াসঙ্গী, এই আজকের আমি। যার একমাত্র কাজ, ফেসবুকে শুধু চুটকী লেখা। কি অধ:পতন।
কিন্তু ক্রিটো কে ছিলেন? সেইযুগে ক্রিটো ছিলেন, সক্রেটিসের এক ধনী বন্ধু যিনি তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। সক্রেটিসের শিষ্য মহাজ্ঞানী প্লেটো একটা বই লিখেছিলেন আমারই নামে, সে বইয়ের নাম 'ক্রিটো'। তাতে সক্রেটিসের সাথে ক্রিটোর সংলাপের বিবরণী আছে। ক্রিটো সক্রেটিসের জেলখানা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা সক্রেটিসের জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত করে গেছেন, প্রহরীদের উৎকোচ দিয়ে তিনি, সক্রেটিসের মুক্তির ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সক্রেটিস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন, তার কাছে শ্রেয় মনে হয়, হেমলক পান করা।
এবার বরং শোনা যাক খুবই সংক্ষেপে সেই মহান শিক্ষকের একদিনের জীবন কাহিনী।
তাহলে শুনুন একদিনের কথা। মানে আমি ক্রিটো, দাঁড়িয়ে আছি, সক্রেটিসের বাড়ীর সামনে। তখনও ভোর হয়নি।আধো অন্ধকারে তখনও এথেন্স ঢাকা। সক্রেটিস বেড়িয়ে এলেন বাড়ী থেকে, খালি গায়ে, গায়ে শুধু একটা মোটা চাদর। আমায় দেখে হেসে বললেন, ক্রিটো তুমি এত ভোরে এসে গেছ? তোমার কি ভয় হয়, আমি পালিয়ে যাব? "
আমি হেসে বললাম ' না গুরুদেব, আমি এসেছি শুধু প্রাত:ভ্রমণের জন্যে"
আস্তে আস্তে সুর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমরা এগিয়ে চললাম, আগোরার দিকে। আগোরা কি জানেন তো? আজকের যাকে আমরা বলি মার্কেট প্লেস, তাই সেকালের আগোরা। সেখানে যে শুধু বেচাকেনা হতো তাই নয় কিন্তু ব্যায়ামাগারও ছিল। গ্রীক ভাস্কর্যে ম্যাসকুলাইন বডি শুধু স্মরণ করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, সে যুগে আজকের জিমন্যাসিয়ামের কতটা কদর ছিল।
আগোরায় বহু লোকের সমাবেশ হতো। সারা এথেন্সের লোক জড়ো হতো সেখানে। এথেন্সের কেন্দ্রস্থলে ছিলো সেই আগোরা। দার্শনিক, ফলবিক্রেতা, সৈনিক থেকে বিভিন্ন পেশার লোক জড়ো হতো সেখানে। সক্রটিসকে ঘিরে ভিড় জমে উঠতো। বিশেষ করে তরুণরা তাকে বেশ পছন্দ করতো। সক্রেটিস শুধু প্রশ্ন করে যেতেন, উত্তর দিতেন না। বলতেন নিজে প্রশ্ন করো, নিজেই এর উত্তর খুঁজে পাবে।
তিনি এক তরুণকে প্রশ্ন করলেন, "বলো তো ন্যায় কি?" তরুণ উত্তর দিলেন, 'আইন মেনে চলাই ন্যায়।'
সক্রেটিসের পালটা প্রশ্ন, " যদি আইন অন্যায় হয়,যদি আইন কেবল সুবিধা দেয় ক্ষমতাবানদের? '
সক্রেটিসকে ঘিরে ভিড় জমে যায়, কিন্তু তিনি কারও সাথে ঝগড়া করেন না। কিন্তু তার প্রশ্নগুলো দাবানালের মতো ছড়িয়ে যায়।
একদিন আমরা গেলাম প্লেটোর বাড়ী, তার প্রিয় শিষ্য। প্লেটো তরুণ, দীপ্তমান চেহারা। প্লেটো ধনাড্য ঘরের ছেলে। তার বাড়ীতেই আমাদের আজকের আহার। সক্রেটিস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, জ্ঞান কি? প্লেটোর উত্তর। যা গুরু শেখান। সক্রেটিস মাথা নাড়লেন। না, গুরু উত্তর দেন না, প্রশ্ন করেন। জ্ঞান তোমার ভেতরেই আছে।
সেদিন আমি দেখলাম প্লেটোর চোখে আগুন জ্বলে উঠেছে। সেদিন আমার মনে হয়েছিল, এই তরুণই একদিন সক্রেটিসের উত্তরাধিকারী হবে।
প্লেটোর বাড়ীতে সেদিনের আহারে ছিল, রুটি, জলপাই, ছাগলের দুধের পনীর আর সুরা। সক্রেটিস সামান্যই খেতেন। আহারের ফাঁকে আলোচনা উঠল। সুখ কি? কেউ বলল ধন, কেউ খ্যাতি। সক্রেটিস বললেন, সুখ হলো আত্মাকে চেনা, অজ্ঞতাকে চেনতে শেখা।
এক বিকেলে আলবিডাসিয়াসিও সঙ্গে এলো। তরুণ, ভীষণ সুদর্শন আর আত্মগর্বী।সক্রেটিস তাকে প্রশ্ন করলেন, ' নেতৃত্ব কি? সে বলল, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা।সক্রেটিস বললেন, "তুমি যা বললে তা ভূল। নেতৃত্ব হলো মানুষকে সত্য দেখানো। তুমি কি তা পারো?"
সক্রেটিসের বিচার
খ্রীষ্টপূর্ব ৩৯৯:
পেলোপনশীয় যুদ্ধে এথেন্স পরাজিত। এথেন্স সন্দেহ আর ক্ষোভে জর্জরিত। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, তিনি দেবতাদের অস্বীকার করেন। যুবকদের বিভ্রান্ত করেন। সক্রেটিস জবাবে বললেন,আমি কিছুই জানিনা। শুধু জানি আমি অজ্ঞ। এ জ্ঞানের জন্যে যদি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে এথেন্স আমাকে নয়, নিজেকেই হত্যা করবে।
বিচারের রায় হলো, তাকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর একটা বিকল্প প্রস্তাবও ছিল। তাকে এথেন্স থেকে নির্বাসিত করে দ্বীপান্তরে পাঠান হবে। কিন্তু তিনি তার প্রিয় এথেন্স ছেড়ে যেতে চাননি।
আমি ক্লিটো, প্রতিদিন জেলখানায় যেতাম। এক রাতে তাকে বললাম। " গুরুদেব, পাহারাদারকে উৎকোচ দিয়ে, আপনার পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আপনি বেড়িয়ে আসুন। থিসোলিতে আপনার নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।"
তিনি হাসলেন, বললেন, " ক্রিটো আমি যদি পালাই, তবে আমি আইন ভাঙব,অন্যায় সহ্য করা শ্রেয়, অন্যায় করা নয়।" আমার দুচোখ জলে ভরে গেল।
শেষের কদিন, আমরা তার শিষ্যরা, তাকে ঘিরে থাকতাম। প্লেটো, ফায়েডো, আপেলোদোরাস সবাই অশ্রুপূর্ণ চোখে তাকে ঘিরে থাকত।তিনি ধীরে বললেন, " যেমন সংগীত বীণা ভাঙলেও টিকে থাকে। আত্মাও দেহের বাইরে জাগ্রত থাকে। মৃত্যু ভয়ের কিছু নয়।"
শেষসকাল
সকালে প্রহরী হেমলকের পাত্র এনে দিল। ঘর নিস্তব্দ। আমরা সবাই কাঁদছিলাম। সক্রেটিস পাত্র হাতে নিয়ে বললেন। " মৃত্যু নিয়তি, ভয় করো না। অসততা ভয়ঙ্কর, মৃত্যু নয়'।
তিনি ধীরে ধীরে হেমলক পান করলেন। তারপর,কিছুক্ষণ পায়চারী করে শুয়ে পড়লেন।
শেষ মূহুর্তে আমাকে বললেন, "ক্রিটো, আক্রলেপিয়াসকে একটা মোরগ দিয়ে দিও। মৃত্যু হলো একটা আরোগ্য। "
তারপরেই তার দেহ, নিস্তব্দ হলো।
আমি বহুক্ষণ তার মরদেহের পাশে বসে রইলাম। মনে হলো, আমার গুরু মারা যাননি। প্রশ্ন হয়েই বেঁচে রইলেন। তিনি আমাদের কোন উত্তর দেননি। তিনি আমাদের কেবল দিয়ে গেলেন জ্বলন্ত প্রশ্ন।
আজ আমি ক্রিটো, সেই প্রশ্ন নিয়েই বেঁচে আছি।
সত্য কোথায়? ন্যায় কি? আত্মা কি অমর?















