Wednesday, 24 April 2019

ভবানীদার গপ্প

ভবানীদার গপ্প

কত বছরই বা হবে। আমাদের বয়স তখন ১৪/১৫,  তার বেশী নয়। এমন কিছু আগের নয়। আসলে এখন ৫৩/৫৪ বছর সময় আমার কাছে কোন সময়ই নয়। নেহাৎই কালকের কথা। সময়ের হিসেব একেবারে পালটে গেছে। আর পালটানোর আসল হোতা হচ্ছে ছোটকা। ছোটকা কিন্তু আমার কাকা বা জ্যাঠা কেউ নয়। ছোটকা আমাদের ফ্যামিলির সবচেয়ে ছোট সদস্য। তাই আমার কাছে কখনও ও ছোটকা, কখনও বা টুটুম। ওর আর একটা নাম আছে যেটা আমার এক্কেবারে পছন্দ নয়। আর সেইজন্য সেটা নিয়ে আমি পাঁচ কান করতেও চাইনা। তবে যা বলছিলাম ৫০/৫৫ বছর কেন আমার কাছে, কোন সময়ই নয়? কারণ আমার সাথে টুটুমের যা কিছু গপ্পসপ্প, সব আলোকবর্ষের হিসেবে।  এই মহাবিশ্ব নিয়ে ওর ভারী আকর্ষণ। রাত্রে ও আমার পাশে শুয়ে ওর প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসে।আর ওর সব কিছু প্রশ্নই এই আকাশ  আর বিশাল মহাবিশ্ব ঘিরে। ও ওর দাদুকে ভাবে ভারী পন্ডিত গোছের কিছু।তাই আমাকেও ওর প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তৈরি থাকতে হয়। চন্দ্র, সূর্য্য, তারা শুধু নয়। ওর আকর্ষণ আরো গভীরে।  নোভা,সুপারনোভা, নিউট্রন, নেবুলা আর এখন শুধু ব্ল্যাকহোল।  আর এ সবের মূলে কিন্তু ইউটিউব। কম্পিউটারের পর্দায় ওর দেখার বিষয় হল এই সব মহাজাগতিক বিষয়। ওটা নিয়ে ওর ভয় ও ভাবনা দুটোই আছে। ব্ল্যাকহোল কতদুরে? সব আলোকবর্ষের হিসেব। কত মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে সেটা বুঝতে, বোঝাতে আমার ভারী মাথা খাটাতে হয়। তবে আমরা দুজনেই একসময় পৌঁছে যায় ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায়। ওর ভারী ভয়, ওর দাদু যেন হারিয়ে না যায় ব্ল্যাকহোলের অতল গভীরে। আমি বোঝায় ভয় কিসের, ব্ল্যাকহোল দিয়ে ঢুকে ঠিক বেরিয়ে আসব হোয়াইট হোল দিয়ে।  জীবনও তো তাই। জীবনের অজস্র ফুটোফোটার ব্লাকহোল পেরিয়ে বাঁচবার পন্থা নিশ্চয়ই আছে। শুধু পথটা চিনে নেওয়া চাই। হোয়াইট হোল তো আমাদের সবারই অপেক্ষায়।

বলতে যাচ্ছিলাম আমাদের নবাব বাহাদুর স্কুলের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ভবানীদার কথা, চলে এলাম বহুদুরে। তবে এ পথ পেরোতে আমার সময় লাগবে না মোটেই।  কল্পনার দৌড় থাকলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভারী হাত ধরাধরি ভাব। তাহলে শুরু করি? সে একটা দুষ্টু মিষ্টি গল্প। ভবানীদা ছিলেন আমাদের কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট।  আর আমার বয়সী ছেলেদের হাত দেখতে তার বেশ আগ্রহ। বেশি কিছু লাগত না। স্কুল ক্যানটিনে একটা চা, বিস্কুট খাওয়ালেই ভবানীদা ভারী মনোযোগ সহকারে  আমাদের হাত নিয়ে বসে পরতেন তা নিরিক্ষন করতে। আর আমাদের বয়সী ছেলেদের মনের গতি প্রকৃতি তার ভারী জানা। বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বলতেন, 'বুঝলে নিলু, একজন তোমাকে খুব পছন্দ করে।" ১৫ বছরের নবীন হার্টও সে অচেনা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশীর সম্ভাবনায় ধড়ফড় করে ওঠে। ' স্কুলে আসার পথে দেখবে তো ভাল করে, একটা বিনু দোলানো মিষ্টি মেয়ে তোমার দিকে আড়চোখে তাকায় কিনা?' যদি তাকায় তবে জানবে ওই সেই মেয়ে। আতিপাতি করে খুঁজে ফিরি? কে সেই মেয়ে। ডলি,মঞ্জু, চায়না?  কে সে? সেটা যে আড়চোখে তাকিয়েই জীবন নদীতে অবগাহনের সময়।  সেই অবগাহন আজও তো শেষ হয়নি। যদিও জানি, ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি তবুও হোয়াইট হোলের রাস্তাওতো আমার জানা৷ ঠিক পৌঁছে যাব জানি একদিন। 

Friday, 19 April 2019

এলোমেলো কথা

 এলোমেলো কথা

বলছি বটে আমার কথা। কিন্তু আদপে আমার কোন কথাই নেই৷ ফেসবুকে ইদানিং দুচার কথা লিখে ফেলি। কিন্তু সেগুলো শুধুই কথার কথা। সেসব কথার কোন মানে নেই,মুল্যও নেই। আমার কিছু কাছের জন আছে যারা দূরে হলেও আমায় ঠিক মনে রাখে মানে মনের মধ্যেই রাখে। তারা আমার এই সব বেচাল কথায় ভারী বিমর্ষ হয়। এই কদিন আগে লিখেছিলুম ইতালির এক আঙুরবাগানের সুন্দরীর কথা যার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল প্রেম হওয়ারও ছিল,কিন্তু সেটা আর ঘটেনি৷ বাংলা ব্যাকরণে কি সব কথা আছে না 'ঘটনাম অতীত',  আমারটা সেইরকমই অনেকটা। তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা অঘটনাম। মানে ঘটা উচিৎ ছিল কিন্তু ঘটলনা। কি আর করা যাবে। আসলে মনের মধ্যে কতরকম ছবি ফুটে ওঠে কেউ কেউ মনে রাখে কেউ উড়িয়ে দেয় ফুৎকারে।  এসব ব্যাপারে আমি ভীষণ সঞ্চয়ী। মনের এই সব ফুলগুলোকে তরতাজা করে রাখি। মাঝে মাঝে তার সুবাস,সৌন্দর্য দুলিয়ে দিয়ে যায়। আর সেই দোলার ভাগ আপনাদেরও দিতে চাই। আর তাতেই কেউ কেউ মনক্ষুন্ন হয় বলে এত বয়স হল তবু্ও অশোকের জ্ঞানগম্যি হল না।
সত্যিই তো বয়স হয়তো অনেক হলো। কবে পেরিয়েছি তিনকুড়ি। তিনকুড়ির কথায় মনে পড়ল আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি গাঁ গঞ্জের অনেকেই কুড়ির বেশি গুণতে পারত না। তাদের সব হিসেবই, কুড়ির গুণিতকে। যেমন তিনকুড়ি দশ,পাঁচ ইত্যাদি ।  এইরকম হিসেব। আমিও  সেরকমই একজন অজ্ঞানী।  আমার সব কুড়ির হিসেব। জ্ঞানী লোকেদের অনেক চোখ। চারিদিকে তাদের ক্ষর দৃষ্টি।  তারা অনেক দূর অনেক গভীরে দেখে । আমি কিন্তু মায়োপিকের দলে। বেশী দূরে দেখি না। আসলে আমি কুড়ির বাইরে বেরোতে চাই না। কুড়িই আমার জন্য যথেষ্ট। এর বেশি হলে সত্যি সত্যিই আমি বুড়িয়ে যাব। আর কেই বা বুড়ো হতে চাই। ওই জন্যই আমার পিঠে বেধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো। যে যাই বলুক আমি এইরকমই। আসলে বলছিলাম না মনের মধ্যে অনেক ছবি আঁকা হয় যা থেকেই যায়, মোছে না কিছুতেই। রবি ঠাকুরের ছিন্নপত্রের এক লেখায় এইরকম ইতালির এক আঙুরবাগান আর কিছু তরুণীর কথা পড়েছিলাম । সে ছবি কখন যেন আমার মনের মধ্যে ঢুকে গেছে আর আমিও সেই ছবির একজন হয়ে গেছি। আর তা নিয়েই যত অঘটন। রমেশ বলল এই বয়সে বউকে জড়িয়েই বেঁচে থাকা আর আমার এক তরুণী বান্ধবী বলল, যান তবে আঙুরবালার খোঁজে। খোঁজ?  সত্যিই এক গভীর কথা। আমরা কে যে কি খুঁজি তা কেই বা জানে। তবু চলা থেমে থাকে না। থেমে যাওয়া নেই আর থেমে গেলেই যে গভীর গহন অন্ধকার।  তাই চলতেই থাকুন। শত শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে যান। এ চলার যেন শেষ না হয়।

পুনশ্চঃ ঘুম আসছিল না, তাই টাইম পাস করছিলাম। এখন ভোর হয়ে আসছে, উঠে পড়ুন,সামনে নতুন দিন। আমি এখন ঘুমোই। 

Sunday, 7 April 2019

হঠাৎ সফর সঙ্গে হামসফর।














হঠাৎ সফর সঙ্গে হামসফর।
হটাৎ শান্তিনিকেতন যেতে হয়েছিল। হটাৎই। কারন বলা নেই, কওয়া নেই। কুন্তলা ধরে বসল, শান্তিনিকেতন যেতে হবে। এবং কালকেই। কারণ? কারণ, কলাভবনের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে, কলাভবন নন্দনে বিনোদবিহারী মুখার্জীর ছবির প্রদর্শনী চলছে এবং তা প্রায় শেষের মুখে।
কুন্তলা আমার বিয়ে করা বৌ, তাই অনেকদিন একসাথে আছি। হটাৎ করে না বলতে পারি নে। যদিও আমি শিল্পী, শিল্পরসিক বা শিল্পবোদ্ধা কোনটাই নই। ছিলামও না কোনদিন। হবার ইচ্ছেও নেই। তবুও যেতে হবেই। কারন কুন্তলার ওসবে ভারী সখ। ওর রুটি রোজগারও ওই শিল্প বেচেই। কথাটা খারাপ শোনাচ্ছে না? শিল্প কি বেচার জিনিষ। মহৎ অর্থে হয়ত নয়। তবে আজকাল সারা সংসার জুড়েই তো শুধুই বেচাকানা। শিল্পীরা দোকানদার হলেই বা ক্ষতি কি? তবে মহৎ শিল্পী বা কালোত্তীর্ণ অনেকেই তো আছেন, যাদের ছবি হয়ত তাদের জীবদ্দশায় তত বিকোয়নি কিন্তু আজ লক্ষ লক্ষ ডলার তার দাম। আমার গগ্যার কথায় মনে আসে। কি অসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু চরম পাগলামি আর ততোধিক দারিদ্র। সমাজ সংসার ছেড়ে, নিরাপদ জীবন ফেলে, তাহিতি কন্যাদের মধ্যে জীবন যাপন। ছবি আঁকা আর তাহিতি কন্যাদের সঙ্গে 'Sex under the mango grove' Oh,what a life.
.ছবি বুঝি চাই না বুঝি। এইরকম একটা জীবনের সাধ আমারো ছিল। এখন বুঝি তা আর সম্ভব নয়। অগত্যা শান্তিনিকেতনই সই। পল গঁগ্যা কে নিয়ে সম্ভব হলে কুরোসাওয়ার একটা ছবি আছে, পারলে দেখবেন। ছবিটার নাম 'Dream'. অনেকগুলো সর্ট ফিল্মের কম্পোজিশন। খুব ভাল লাগবে। আমার একজন প্রিয় সাহিত্যিক সসমারসেট মম। মমও গঁগ্যার আকর্ষন কাটাতে পারেননি। ওকে নিয়ে আস্ত একটা উপন্যাসই লিখে ফেলেছেন। বলুন তো কোনটা? ' The moon and the sixpense'. এর নায়ক চার্লস স্টিকল্যান্ড, শেয়ার মার্কেটের দালাল। গঁগ্যার আদলে গড়া। হঠাৎই তার মনে হল, I am destined to be an artist. আর তিনি সব ছেড়েছুড়ে চললেন তাহিতি দ্বীপে। এইরকম ইচ্ছে আমার অনেকবারই হয়েছে। অবশ্য শিল্পী হতে নয়। ধরূণ ভুপর্যটক হতে। কিন্তু 'Escape velocity' জোগাড় করতে পারিনি। বাঙ্গালির ছাতির জোর বড়ই কম। এই ভুপর্যটক হবার লোভ আমার রাশিয়ান গল্প/উপন্যাস পড়ে। বেলেকিনের একটা গল্প ছিল এক ভবঘুরে ছেলের এক অজানা শহরের মেয়ের প্রেমে পরার। সে প্রেম অবশ্য পরিণতি পায়নি। সেই থেকে আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে আছে একটুকরো লোভ, এক মেমসাহেবকে বিয়ে। সে তো আর এই জন্মে হল না মশাই। এখন এই দিশি কালো মেমসাহেবকে নিয়ে রওনা দিই বিনোদ বিহারীর সন্ধানে।
এবার আসল কথায় ফিরি। শান্তিনিকেতন তো পৌছে গেলাম। আর শান্তিনিকেতন আরামে ঘুরতে হলে টোটোর কোন বিকল্প নেই। পৌছে গেলাম নন্দন, কলাভবনে। বিনোদবিহারীকে অল্পবিস্তর আপনারা সবাই তো জানেন। কলাভবনের শিক্ষক ছিলেন কিছুকাল। রামকিংকর, মানিদা, মুজতুবা আলি এরা সব একবাগানের ফুল ছিলেন। আপনারা যতটুকু জানেন এদের সমন্ধে, আমি তার থেকে বেশী কিছুই জানিনা। বিনোদবিহারী সম্মন্ধে আমি প্রথম জানতে পারি, সত্যজিৎ রায়ের একটি ডকুমেন্টারি থেকে, 'The inner eye'. সে বোধহয় আশির দশকের প্রথম দিকে। ওনার দৃষ্টি খুব ক্ষীণ ছিল। পরে তো অন্ধই হয়ে যান। তা সত্বেও অদ্ভুত সব ছবি একে গেছেন।
সেইসব ছবির ছবি তোলা বারণ। তাও আমি লুকিয়ে চুরিয়ে স্রেফ আপনাদের জন্যই কিছু ছবি তুলে এনেছি । এই নন্দনে কলাভবনের পঞ্চকন্যার এক প্রদর্শনী চলছিল। তারও কিছু ছবি দিলাম। এইসব ছবি যদি আপনাদের ভাল লাগে, তবেই আমার এই চুরি করা সার্থক। আমার এই মহাপাপের ভাগীদার হবেন তো? না আমাকে আবার বাল্মীকির মতই ডিচ করবেন?