Friday, 19 April 2024

গুষ্টিসুখ

 গুষ্টিসুখ।


আজ অনেকদিন পরে গুষ্ঠিসুখের আনন্দ ফিরে পেলেম। আমরা যখন স্কুলে,অফুরন্ত বন্ধু আর  হইচই,দুচোখ ভরা স্বপ্ন আর স্বপ্ন আর অজস্র হাতছানি। তখনই জেনেছিলেম গুষ্টিসুখ কাকে বলে। পরে সেই জানা আরও গভীর হয়েছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা পড়ে। 


আমাদের কৈশোরের সঙ্গী ছিল অনেকেই। তার মধ্যে  একজন চে আর অন্যজন অবশ্যই মুজতবা আলি। তো এই গুষ্টিসুখের প্রথম পরিচয় মুজতবার লেখা থেকেই। গুষ্টিসুখ যে তার আগে ছিলনা,  তা নয়। তবে সেটা যে গুষ্টিসুখ সেটা প্রথম বুঝলুম মুজতুবা আলির লেখা পড়েই।  হাজারদুয়ারির সিঁড়িতে বসে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে ভাগাভাগি করে সুখটান, চারুকে নিয়ে ভাগাভাগি, সে গুষ্টিসুখ হয়ত আজ আর ফিরে পাব না। তবে তাই বলে হারিয়েও তো যায়নি।  তার আগে বলি চারুকে কেউ ভুল বুঝবেন না। একটা সময়ে আমাদের প্রিয় ছিল 'নষ্টনীড়ের চারুলতা আর চারমিনার সিগারেট।  আমরা চারমিনার কে আদর করে বলতেম চারু। ঠিক ভুপতির মত। আমাদের আর কেউ নেই 'চারু তো আছে।' সেই কালও নেই। নেই সেই চারমিনারও। আর সেই ছেলেবেলা সে তো ছিল কোন কালীদাসের কালে।


তবুও এই বৃদ্ধ বয়সে, বৃদ্ধ বলব না, বড্ড বাজে শোনায়। আসলে পালটে পালটে নিলে, কেউ বুড়োই হয়না কোনদিনই। এই পরিণত বয়সে বন্ধুর অভাব পরেনি আজও।  সেইরকম বন্ধুরা মিলে জড় হয়েছিলুম বেশ কিছুদিন বাদে। শেখর বেশ কিছুদিন বাদে আবার এলো দিল্লি থেকে। সেই উপলক্ষেই আজকের জমায়েত ।  জমজমাট, খাদ্যে ও পানীয়তে। তার রঙে, যদি লালের আধিক্য কেউ দেখেও থাকেন, দোষ নেবেন না প্লিজ।  এতে যেটুকু গুলাল যেটুকু নেশা সব সেই পুরোন দিনকে মনে রেখেই। তেমনি নিষ্পাপ, তেমনি অমলিন।  সারাটা দুপুর বেশ কাটলো গল্পে, গল্পে, এলোমেলো আর অপরিণত কথায়। আসলে আমরা কেউই তো বড় থুড়ি বুড়ো হয়নি। শেষ বলেও কি কিছু হয়? যা হয় তা রুপান্তর। মানিয়ে নিলেই বেশ ছিমছাম। মনে হয় শেষ হয়েও না হইল শেষ। বন্ধুত্তের আকর্ষন ও তেমনই। গুষ্ঠীসুখের থেকে বড় সুখ যে আর কিছু নেই। সে যে পুরোন হয়ে যাবার জড়ত্ত্বকে ধুয়ে মুছে ফেলতে পারে একনিমেষে।

Wednesday, 17 April 2024

এলোমেলো কথা

 পুনশ্চ

এলোমেলো কথা


বলছি বটে আমার কথা। কিন্তু আদপে আমার কোন কথাই নেই৷ ফেসবুকে ইদানিং দুচার কথা লিখে ফেলি। কিন্তু সেগুলো শুধুই কথার কথা। সেসব কথার কোন মানে নেই,মুল্যও নেই। আমার কিছু কাছের জন আছে যারা দূরে হলেও আমায় ঠিক মনে রাখে মানে মনের মধ্যেই রাখে। তারা আমার এই সব বেচাল কথায় ভারী বিমর্ষ হয়। এই কদিন আগে লিখেছিলুম ইতালির এক আঙুরবাগানের সুন্দরীর কথা যার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল প্রেম হওয়ারও ছিল,কিন্তু সেটা আর ঘটেনি৷ বাংলা ব্যাকরণে কি সব কথা আছে না 'ঘটমান অতীত',  আমারটা সেইরকমই অনেকটা। তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা অঘটমান। মানে ঘটা উচিৎ ছিল কিন্তু ঘটলনা। কি আর করা যাবে। আসলে মনের মধ্যে কতরকম ছবি ফুটে ওঠে কেউ কেউ মনে রাখে, কেউ উড়িয়ে দেয় ফুৎকারে।  এসব ব্যাপারে আমি ভীষণ সঞ্চয়ী। মনের এই সব ফুলগুলোকে তরতাজা করে রাখি। মাঝে মাঝে তার সুবাস,সৌন্দর্য দুলিয়ে দিয়ে যায়। আর সেই দোলার ভাগ আপনাদেরও দিতে চাই। আর তাতেই কেউ কেউ মনক্ষুন্ন হয় বলে এত বয়স হল তবু্ও অশোকের জ্ঞানগম্যি হল না।

সত্যিই তো বয়স হয়তো অনেক হলো। জীবনানন্দের ভাষায়, " জীবন গিয়াছে চলি  আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার,তখন হটাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার...!   কবে পেরিয়েছি তিনকুড়ি। তিনকুড়ির কথায় মনে পড়ল আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি গাঁ গঞ্জের অনেকেই কুড়ির বেশি গুণতে পারত না। তাদের সব হিসেবই, কুড়ির গুণিতকে। যেমন তিনকুড়ি দশ,পাঁচ ইত্যাদি ।  এইরকম হিসেব। আমিও  সেরকমই একজন অজ্ঞানী।  আমার সব কুড়ির হিসেব। জ্ঞানী লোকেদের অনেক চোখ। চারিদিকে তাদের ক্ষর দৃষ্টি।  তারা অনেক দূর অনেক গভীরে দেখে । আমি কিন্তু মায়োপিকের দলে। বেশী দূরে দেখি না। আসলে আমি কুড়ির বাইরে বেরোতে চাই না। কুড়িই আমার জন্য যথেষ্ট। এর বেশি হলে সত্যি সত্যিই আমি বুড়িয়ে যাব। আর কেই বা বুড়ো হতে চাই। ওই জন্যই আমার পিঠে বেধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো। যে যাই বলুক আমি এইরকমই। আসলে বলছিলাম না মনের মধ্যে অনেক ছবি আঁকা হয় যা থেকেই যায়, মোছে না কিছুতেই। রবি ঠাকুরের ছিন্নপত্রের এক লেখায় এইরকম ইতালির এক আঙুরবাগান আর কিছু তরুণীর কথা পড়েছিলাম । সে ছবি কখন যেন আমার মনের মধ্যে ঢুকে গেছে আর আমিও সেই ছবির একজন হয়ে গেছি। আর তা নিয়েই যত অঘটন। রমেশ বলল এই বয়সে বউকে জড়িয়েই বেঁচে থাকা,  ভারী মনক্ষুন্ন হল আমার এই বেয়াদপীতে। আর আমার এক তরুণী বান্ধবী বলল, যান তবে আঙুরবালার খোঁজে। খোঁজ?  সত্যিই এক গভীর কথা। আমরা কে যে কি খুঁজি তা কেই বা জানে। তবু চলা থেমে থাকে না। থেমে যাওয়া নেই আর থেমে গেলেই যে গভীর গহন অন্ধকার।  তাই চলতেই থাকুন। শত শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে যান নতুন সুর্যের সন্ধানে। এ চলার যেন শেষ না হয়।


পুনশ্চঃ ঘুম আসছিল না, তাই টাইম পাস করছিলাম। এখন ভোর হয়ে আসছে, উঠে পড়ুন,সামনে নতুন দিন।

Sunday, 14 April 2024

চড়কের মেলা

 আজ ঘুরে এলাম চড়কের মেলা ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ী আর বাজারের সামনে।  সারা বিডন স্ট্রিট জুড়ে মেলার বিকিকিনি।  মেলা কিন্তু এই একদিনই।  তবে চলবে সারারাত। দারুণ কালারফুল, রাস্টিক আর ভাইব্রেটিং। আর হবে নাই বা কেন।  বেঙ্গল রেঁনেসা'র গর্ভগৃহ তো এইসব অঞ্চলই। ভীষণ একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম জুড়ে থাকে এই সব কিছু ঘিরে৷ আর যা কিছু পুরনো তা যে ভীষণ মনকাড়া।  তাই তো বারবার ফিরে ফিরে আসি এই সব জায়গায়। পুরনো কলকাতা তার যূগপুরুষরা৷ রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র আরও অসংখ্য গুণীজন যেন চলতে থাকে আমার সাথে। আমার তো ভীষণ ফ্যাসসিনেটিং লাগে।

এবার এই চড়কের ২০০ বছর পেরিয়ে গেল। ভাবা যায়? ওয়াজেদ আলি থাকলে হয়ত আর একবার বলতেন 'সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে'। হ্যাঁ, কিছু কিছু জিনিস তো একইরকমভাবে চলছে।  আর চলবেও। এগুলো শ্বাশত।  আর শিব যে শ্বাশত সুন্দর। তার কোন পরিবর্তন নেই। 


এ উৎসব শিবের। আর হিন্দু সমাজে শিবের এক বিশেষ স্থান। শিবের পরিচয় দেবাদিদেব মহাদেব  নামে। নেশা ভাং করেন আর এখানে ওখানে পরে থাকেন। তাও মেয়েমহলে শিবের খুব উচ্চাসন। সব মেয়েরাই শিবের মত বর চান। কিন্তু দেখুন আদপে তা কিন্তু নয়। আমরা বন্ধুরা যদি নমাসে ছমাসে একটু শিবকে অনুসরণ করি তা নিয়েই দক্ষযজ্ঞ হয়ে যায়। বুঝুন শিবভক্তির হাল। শিবের পৌরাণিক কাহিনি অল্প-বিস্তর সবার জানা। তবে আপনারা কেউ কি আমিশ ত্রিপাঠীর 'Immortals of Meluha' পড়েছেন? তাতে শিব কিন্তু এক উপজাতীয় বীর। তিব্বতের ওপাড় থেকে হিমালয় পেরিয়ে কাশ্মীরের ওপর দিয়ে এসেছেন সিন্ধু উপত্যকার এক রাজার আমন্ত্রণে তার রাজত্ব রক্ষার্থে।  সেই রাজাই দক্ষ আর রাজকন্যে পার্বতী। মাঝে বিস্তর ঘটনার ঘনঘটা।  তাতে শিবের বীরত্ব,মহত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত।  পড়তে বেশ লাগে। হাতে পেলে পড়ে নেবেন বইটা। 


যাহোক, চড়কের মেলা কিন্তু একই চেহারায়৷ সেই গ্রাম্য আদলের মেলা আর চড়কের বাই বাই ঘোরা৷ এর মধ্যে একজায়গায় খুব ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভীড় ঠেলে দেখি সব আমার ভীষণ প্রিয় প্রিয়দর্শিনীরা রসের সাগরে ভাসছেন just আমার অপেক্ষায়।  কি করলাম? কিছুই করতে পারলাম না। শুধু ছবি তুলে ফিরে এলাম। তারা কারা, শুনবেন?  জিলাবি, পান্তুয়া, ক্ষীরের চপ, বালুসাই ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে তাদের ছবি  তুলেএনেছি আপনাদেরই জন্য। ছবি দেখেই বুঝবেন কি মোহময়ী তাদের আবেদন,সঙ্গে সঙ্গে আমার সংযম কেও সাবাসী দিতে ভুলবেন না।

Sunday, 7 April 2024

বিলে

আজ সকাল সকাল যেতে হয়েছিল বিষ্টু ঘোষের পাড়ায়। কি দরকারে সেটা না হয় নাই বললাম। আর সবকিছুই যে ঢেরা পিটিয়ে বলতে হবে এমন পেটপাদলা আমি নয়। আর সে সব শুনেও আপনাদের এমন কিছু বেম্মজ্ঞান হবেনি। আখড়ার কাছেই বিলের সাথে দেখা। বিলে কে চেনেনা এ তল্লাটে এমন কেউ নেই। বিরাট শিশু বলতে যা বোঝায় তাই। যেমন বিশাল দেহ তার তেমনি বিশাল মন। একদমই অল্প বয়স।  তবে এ পৃথিবীতে বিলে জানেনা বা চেনেনা এমন জিনিস নেই। যেখানে গপ্পের গন্ধ পাবে, বিলে ঠিক সেঁধিয়ে যাবে। তখন তাকে নড়াই কার সাধ্যি। মোহনবাগান অন্ত প্রান৷ ক্লাবের দুঃখে বিলের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। খাঁটি ঘটির বাচ্চা। ক্লাবের হয়ে জান লড়িয়ে দেবে। যেখানে মো'নবাগান সেখানেই বিলে হাজির সে শিলিগুড়ি হোক বা চেন্নাইই। সেই বিলের বড় দুঃখ।  কবে বিএ পাস দিয়েছে আজ পর্যন্ত একটা ভদ্রস্থ চাকরি জুটল না। যে কথা বলছিলাম।  বিলে ধরল গে ঠিক শ্রীমাণির বাজারের মুখটাতে। ও আমাকে জ্যেঠু বলে ডাকে। বলল জ্যেঠু, শুনেছ, শম্ভু কাকা তোমায় কিছু বলেছে? আমি বলি না তো রে বিলে,কি হয়েছে? বলে  বলেনি? তাহলে থাক, জানলে শম্ভু কাকা আমার উপর রাগ করবে। আমি বলি বলে ফেল না আমি আর শম্ভুকাকা কি কিছু আলাদা। এক মুহুর্তেই বিলে সব উগরে দিল ওর ক্ষোভ দুঃখের কথা। শম্ভুকাকা যে কাজটা ওকে যোগাড় করে দিয়েছে, সেটা ওর মোটেই পছন্দ নয়। ও তাই ঠিক করেছে, চাগরীটা ছেড়েই দেবে।
আপনারা শুনলেন তো বিলের কথা। ভারী ভাল,সরল, সৎ ছেলে। দেখুন না যদি ওর জন্যে ভদ্রস্থ কিছু চাকরীর জোগাড় হয়। আমার অনুরোধ রইল।

বিলের সাথে গপ্পে কেটে গেল অনেকটা সময়। একটু মার্কেটিংও করলাম, জানেন। বিরাট কিছু নয়। আমার পছন্দের ধুলো শাক,সজনের ফুল আর মাছের মধ্যে কাঁচকি আর ফলি। আমার বাজারের সওদা শুনে জানি অনেকেই মৃদু মৃদু হাসবেন। হাসুন। তাতে আমার বয়েই গেল। আমার আজকের মেনু সজনে ফুলের বড়া,ধুলোর শাক, কাচকি র চচ্চড়ি আর বড়ি দিয়ে ফলি মাছের ঝোল। ইচ্ছেটা পেশ করলাম। জানিনা শেষ পর্যন্ত পাতে পড়বে কিনা।

গেঁয়োখালির কড়চা

 গেঁয়োখালির কড়চা


অশোক রায় 


সামতাবেড়ের শরৎবাবুর গ্রামের মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই ননীর ডাক এল গেঁয়োখালি যাবার৷ এর আগে শরৎবাবুর রুপনারায়নের কোলে তার গ্রাম আর রুপনারায়নের রুপে আমি মজে গেছি৷ ওই যে কে যেন লিখে গেছেন না, রবিবাবু নিশ্চয়, " রুপনারানের কুলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ সত্য নয়"! আমারও ওইরকমই একটা উপলব্ধি হল। আগে গ্রাম সম্মন্ধে আমার নাক সিঁটকানো একটা  ব্যাপার স্যাপার ছিল। সেটা একদম কেটে গেছে। তাই গেঁয়োখালি যতই গেঁয়ো হোক না কেন। আমার কোন আপত্তি নেই তার সঙ্গ করতে। তাই রাজী হতে সময় নষ্ট করিনি মোটেই।  এ গ্রাম আবার যেখানে সেখানে নয় গঙ্গা, রুপনারায়ন আর সমুদ্রের ত্রিবেণী সঙ্গমে। তাছাড়া গেঁয়োখালি নিয়েই আমার একটা মনখারাপ ছিলই। আপনার সবাই জানেন, একটা বাচ্চা ডলফিন তার সঙ্গ ছেড়ে এসে পরেছিল গেঁয়োখালি নদীতে। বাঁচান যায়নি। কি করেই বা বাঁচে সমুদ্র থেকে এসে এই ছোট নদীতে?


যা হোক, শেষমেশ উঠেই পড়লাম হলদিয়া লোকালে। লোকাল শুনে ভুরু কোঁচকাবেন না। এ লোকাল কিন্তু পক্ষীরাজকেও হার মানায়। কিছুটা দৌড়ে আর  উড়ে পৌঁছে দিল সতীশ সামন্ত হল্টে। এই হল গেঁয়োখালির স্টেশন। এখান থেকে টুকটুক। আমরা ৬ জন। ও হো সবার সাথে আপনাদের পরিচয় করানো হয় নি। আমাকে তো চেনেনই।  একজন আম আদমি।  আজকাল আম আদমি কথাটা বেশ খায় পাবলিকে। আম আদমি কিন্তু বেশ শক্তি ধরে। তাই আমাকেও হেলাফেলা করবেন না। আর আমাদের দল মানে "ননীগোপালের দল" যার আমরা লাইফ মেম্বার তার সেনাপতি"ননী"। আছে তরুণ যেমন লম্বা তেমনি চওড়া আর যাত্রাদলের রাবণের মত পিলে চমকানো গলার আওয়াজ আর এক এক চুমুকে সুরা কি সমুদ্র শুষে নেবার অসীম ক্ষমতা। আছে সুব্রত। ভারী হিউমারিস্ট ছেলে, আর বড়ো শিব, চন্দ্রনাথ।  চন্দ্রনাথ এর পরিচয় এখন উহ্যই থাক। এক লাইনে শেষ হবার নয়, ওর পরিচয় দেব যথাসময়ে, যথাস্থানে।  গৌতম কে সবাই তো আপনারা চেনেনই। আমরা সঙ্গী ছিলাম টাইগার্স নেস্টের চুড়োয় ওঠার সময়। ভারী ভালোমানুষ।  বারবার আমায় তার রাঁচীর বাড়ীতে যেতে বলেন। এবার যেতেই হবে। পাগলা গারদ বলে এতদিন এড়িয়ে গিয়েছি। এবার যাবোই যাব।


সবার পরিচয় তো পেলেন, এবার সামনে এগোই।  টুকটুকে করে টুকটুক করে পৌঁছে গেলাম হলদিয়া পোর্ট অথোরিটির গেষ্ট হাউসে। দারুণ ঘর, দারুন লোকেশন আর দারুণ দারুন ব্যাবস্থা।  এত সব দারুণ যখন, দারু কি অনুপস্থিত থাকতে পারে। ননীর এ সব ব্যাপারে ভারী উঁচু নজর। একদম ব্লু ক্যাটাগরির ব্যবস্থা। সঙ্গে মাছ, সোহাগি আঁচে ভাজা, ওপরে সোনালি আর ভেতরে নরম অনাস্বাদিত স্বাদ। এই পর্ব চলল যেমন চলে। এসব বলে বোঝানো যাবে না। যে জন জানহ 

 করহ সন্ধান। দুপুরেও হল জম্পেশ খাওয়া দাওয়া। তারপর সেলিমের টুকটুকে লঞ্চ ঘাট আর লঞ্চে চেপে গাদিয়াড়া। গাদিয়ারা লোকে কেন যে যায়? হতাশ হতে হল এর ছিরি দেখে। 

ফিরে এসে আবার আড্ডা আবার মৌতাত। বেশ জমজমাট আড্ডা চলল রাত পর্যন্ত।  রাতে দেশী মুরগীর পাতলা ঝোল।  আর কি চায় জীবনে?  এইরকম গড়িয়ে গড়িয়ে রসেবশে কেটে যাক জীবন। চাই নে মা আমি রাজা হতে।


এর পর?  এর পর শিব্রামের সেই বিখ্যাত উক্তির মত " ঘুম,  ঘুম থেকে উঠে বিশ্রাম আর রাবড়ি। " আমাদেরও চায়ের পর রাবড়ি(?) দিয়ে শুরু। বাইরে এলে আমরা ঠিক সকাল সন্ধ্যে মানি না। চলে মানে চলতেই থাকে রসে আর বশেও। বাড়াবাড়ি একদম নয়। পরের দিন অনেক কিছু দেখলাম টুক টুক করে। সুন্দর সবুজ গ্রাম।  গ্রাম আর সেই গ্রাম নেই চকচকে রাস্তা। মানুষজন, ঘরবাড়ি সবই বেশ চকচকে৷ গ্রামের মানুষেরা বেশ ভালই আছেন, সচ্ছল, সচ্ছন্দ। বেশ ভাল লাগল দেখে। চার্চ, রামকৃষ্ণ মিশন, মন্দির, মসজিদ সব বেশ আছে পাশাপাশি।  ফেরার পথে মহিষাদল।  মহিষাদল রাজবাড়ী তো সবাই দেখেছেন। কিন্তু খেয়েছেন কি "সুরভী " তে? খাবেন একবার। আমি একটু খাওয়ার গপ্প করতে ভালবাসি। কি খেলাম শুনুন। ভাত তো বটেই সঙ্গে করলা ভাজা, মুগের ডাল,আলুভাজা, বেগুনের ঝাল(অনবদ্য), পাঁচমিশেলি সব্জী, পুকুরের চিংড়ি অনবদ্য স্বাদ, নরম আর মাথাভর্তি ঘিলু, চাটনি, পাপড় আর মিষ্টি মিষ্টি দই। ভাল না? যা হোক সব ভালোরই শেষ থাকে। যা যা বলা হল না দেখে নেবেন ছবিতে।  ফেরা সেই পক্ষীরাজেই। দু'ঘন্টায় হাওড়া। শেষ হয়েও হবেনাকো শেষ। সামনের শুক্কুরবার আবার শুরু। এবার লম্বা ট্যুর। বিরাট দল। দল সেই একই। আমাদের আস্থা "ননীগোপালের দলেই"!

Saturday, 6 April 2024

পান্তাভাত ও চোদ্দ ভূতের বাড়ী

 পান্তাভাত ও চোদ্দ ভূতের বাড়ী


মনে আছে তো সেই পুরনো হিন্দি গানটা?

"ডর লাগে তো গানা গা, ডর লাগে তো গানা গা" পুরনো হিন্দি সিনেমা। 

সত্যিই ভয় ভয় একটু লাগছে। শুধু আমারই না সবারই বোধহয়।  কেন সে তো সবাই জানেনই। তার নামটাও মুখে আনতেও গা ছমছম করছে। তবে কিনা ফুলবাগানের এই যে বাড়ীটা যেখানে আমরা থাকি তা ভুতেরই বাড়ী। চোদ্দো ভূত, মানে চোদ্দোজন ভুততুতো ভাই, বোন।সব ভুতের আলাদা আলাদা করে আজ আর পরিচয় দেবার অবকাশ নেই। মেছো ভুত,গেছো ভুত, বাঙাল ভুত,ঘটি ভুত হরেক রকমের ভুত সব।একটা গুহ্য কথা বলি? বাঙাল ফিমেল  ভুতেরা ভারী লড়াকু কিন্তু , আর গলায় ভারী তেজ। এদের তেজেই কিনা জানিনা, রায়, দত্ত মিত্রের দল ভারী কোনঠাসা। কিন্তু এখন সব ভুতই অদ্ভুত আচরণ  করছে, কাজকর্ম তো শিকেয়। ভুতের দল সব তিনতলার চিলেকোঠায় পা দুলিয়ে বসে একসুরে গাইছে। ওই যে বললাম, ডর লাগে তো গানা গা। আর একের পর এক চলছে, চায়ে পে চর্চা, বুজবুজের আসর, চুলকাটার সেলুন। এসব চলছেই এবেলা ওবলা। 


তবে আজ বসেছিল একটু অন্যরকম আসর। লাঞ্চে আজ গুষ্টির শান্তিকল্পে  ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা, চিল চিল পান্তাভাতের আসর। গোটা বাড়ীর পাত পড়েছিল একসাথে। সবাই গপগপ নয় সপসপ করে খেয়ে নিল । নেবু,নঙ্কা আর পেয়াজুঁ দিয়ে। সঙ্গে আলুচোখা আর কালকের আমডাল,  বেশ লাগল কিন্তু। বেশ জোস এসে গেল। ইমুইনিটি যেন একধাক্কায় বেড়েই গেল অনেকটাই। মনে হল হাম হঙ্গে কামইয়াদ। এই বন্দীদশার ভয় কাটাতে আর কি কি চাই? পান্তাভাত আজ সুপারডুপার হিট। আমি বলি কি আপনারাও বসিয়ে দিন পান্তাভাতের আসর। এতে শুধু সময় আর পরিশ্রমই বাঁচবে না। বাড়বে আপনার ইমুইনিটি আর লড়াই করার জোশ। আর যেটার স্টক আপনার প্রায় শেষ, সেটাও পেয়ে যাবেন পান্তাভাত আর কদিন জমিয়ে রাখলেই। তখন আপনি আহ্লাদে গড়াগড়ি যাবেন নির্ঘাৎ।  তবে আমাকে দুর থেকে আর্শীবাদ করতে ভুলবেন না। আর যাই ভুলুন, ভুলবেন না safe distacing.. ঠিক কিনা?

ভবানীদার গল্প

 



ভবানীদার গপ্প


কতই বা বয়স হবে আমাদের  তখন ১৪/১৫,  তার বেশী নয়। এমন কিছু আগের নয়। আসলে এখন ৫৩/৫৪ বছর সময় আমার কাছে কোন সময়ই নয়। নেহাৎই কালকের কথা। সময়ের হিসেব একেবারে পালটে গেছে। আর পালটানোর আসল হোতা হচ্ছে ছোটকা। ছোটকা কিন্তু আমার কাকা বা জ্যাঠা কেউ নয়। ছোটকা আমাদের ফ্যামিলির সবচেয়ে ছোট সদস্য। তাই আমার কাছে কখনও ও ছোটকা, কখনও বা টুটুম। ওর আর একটা নাম আছে যেটা আমার এক্কেবারে পছন্দ নয়। আর সেইজন্য সেটা নিয়ে আমি পাঁচ কান করতেও চাইনা। তবে যা বলছিলাম ৫০/৫৫ বছর কেন আমার কাছে, কোন সময়ই নয়? কারণ আমার সাথে টুটুমের যা কিছু গপ্পসপ্প, সব আলোকবর্ষের হিসেবে।  এই মহাবিশ্ব নিয়ে ওর ভারী আকর্ষণ। রাত্রে ও আমার পাশে শুয়ে ওর প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসে।আর ওর সব কিছু প্রশ্নই এই আকাশ  আর বিশাল মহাবিশ্ব ঘিরে। ও ওর দাদুকে ভাবে ভারী পন্ডিত গোছের কিছু।তাই আমাকেও ওর প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তৈরি থাকতে হয়। চন্দ্র, সূর্য্য, তারা শুধু নয়। ওর আকর্ষণ আরো গভীরে।  নোভা,সুপারনোভা, নিউট্রন, নেবুলা আর এখন শুধু ব্ল্যাকহোল।  আর এ সবের মূলে কিন্তু ইউটিউব। কম্পিউটারের পর্দায় ওর দেখার বিষয় হল এই সব মহাজাগতিক বিষয়। ওটা নিয়ে ওর ভয় ও ভাবনা দুটোই আছে। ব্ল্যাকহোল কতদুরে? সব আলোকবর্ষের হিসেব। কত মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে সেটা বুঝতে, বোঝাতে আমার ভারী মাথা খাটাতে হয়। তবে আমরা দুজনেই একসময় পৌঁছে যায় ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায়। ওর ভারী ভয়, ওর দাদু যেন হারিয়ে না যায় ব্ল্যাকহোলের অতল গভীরে। আমি বোঝায় ভয় কিসের, ব্ল্যাকহোল দিয়ে ঢুকে ঠিক বেরিয়ে আসব হোয়াইট হোল দিয়ে।  জীবনও তো তাই। জীবনের অজস্র ফুটোফোটার ব্লাকহোল পেরিয়ে বাঁচবার পন্থা নিশ্চয়ই আছে। শুধু পথটা চিনে নেওয়া চাই। হোয়াইট হোল তো আমাদের সবারই অপেক্ষায়। 


বলতে যাচ্ছিলাম আমাদের নবাব বাহাদুর স্কুলের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ভবানীদার কথা, চলে এলাম বহুদুরে। তবে এ পথ পেরোতে আমার সময় লাগবে না মোটেই।  কল্পনার দৌড় থাকলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভারী হাত ধরাধরি ভাব। তাহলে শুরু করি? সে একটা দুষ্টু মিষ্টি গল্প। ভবানীদা ছিলেন আমাদের কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট।  আর আমার বয়সী ছেলেদের হাত দেখতে তার বেশ আগ্রহ। বেশি কিছু লাগত না। স্কুল ক্যানটিনে একটা চা, বিস্কুট খাওয়ালেই ভবানীদা ভারী মনোযোগ সহকারে  আমাদের হাত নিয়ে বসে পরতেন তা নিরীক্ষন করতে। আর আমাদের বয়সী ছেলেদের মনের গতি প্রকৃতি তার ভারী জানা। বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বলতেন, 'বুঝলে নিলু, একজন তোমাকে খুব পছন্দ করে।" ১৫ বছরের নবীন হার্টও সে অচেনা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশীর সম্ভাবনায় ধড়ফড় করে ওঠে। ' স্কুলে আসার পথে দেখবে তো ভাল করে, একটা বিনু দোলানো মিষ্টি মেয়ে তোমার দিকে আড়চোখে তাকায় কিনা?' যদি তাকায় তবে জানবে ওই সেই মেয়ে। আতিপাতি করে খুঁজে ফিরি? কে সেই মেয়ে। ডলি,মঞ্জু, চায়না?  কে সে? সেটা যে আড়চোখে তাকিয়েই জীবন নদীতে অবগাহনের সময়।  সেই অবগাহন আজও তো শেষ হয়নি। যদিও জানি, ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি তবুও হোয়াইট হোলের রাস্তাওতো আমার জানা৷ ঠিক পৌঁছে যাব জানি একদিন।

Friday, 5 April 2024

জীবন পাত্র উছলি উঠেছে

 ...জীবন পাত্র উছলি উঠেছে...


রোববার আমার ছুটির দিন। এ দিন আমি কোন চেনা রাস্তায় ঢুকিনা। না করি কোন কাজ। অনেকেই বলেন, বিশ্রাম করুন। আসলে বিশ্রাম যে কি তা আমার মাথায় ঢোকেনা মোটেই। বিশ্রাম মানে যদি চুপচাপ শুয়ে বসা হয়ে থাকে তাহলে তো সে রীতিমতো অত্যাচার।  তাই বিশ্রাম মানেই আমার কাছে অচেনা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। বা ধরুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, বই পড়া এইসব। এই রোববার ঠিকই ছিল ভবানীপুরে সুজিতের বাড়ী যাব। সুজিতের জন্মদিন গেছে কদিন আগে। তাই সুজিতের বাড়ীতেই আমি আর পল্টা পৌঁছে গেলাম সময়েই। সুজিতের দাদা সুব্রতদা আমাদেরও বন্ধু। এর আগেও আমরা একসঙ্গে পঞ্চলিঙ্গেশর, বালাসোর ঘুরে এসেছি। এরকম দাদা যার আছে সেই ভাইয়েরা কেউ খারাপ হতেই পারে না। তাই আমরাও কেউ খারাপ নয়। ভারী সুশীল আর সজ্জন। আর সুজিতের কথা,  'কেয়া কহেনা'! এরকম বন্ধু যার আছে, সে ওর ঘাড়ে সব ভার চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। সুজিত সব সামলে নেবে।  সুব্রতদার সাথে অনেকদিন বেরোন হয়নি সেইরকমই আর একটা প্রোগ্রাম চটজলদি ফিক্স হয়ে গেল,পুজোর পরে পরেই। এবার ননীর সাথে বসে একটু ফাইন টিউন করতে হবে। এখন আমাদের প্রতি মাসেই বাইরে যাবার আমন্ত্রণ।  নদী পর্বত, জল জঙ্গল পরিক্রমা চলবে প্রায় প্রতি মাসেই। 

সে যাই হোক, সুজিতের বাড়ী যখন গেছি জন্মদিনের অজুহাতে ও কি আর ছাড়বে মিষ্টি ছাড়া। ভবানীপুরের অলিতে গলিতে মিষ্টির দোকান।  তাই থালা ভর্তি মিষ্টি নিয়ে হাজির সুজিতের ঘরণী। আমার আবার খেতে ভাল  লাগে না,  তাই মিষ্টি। ভাগ্যিস পল্টা ছিল, তাই ওর প্লেটে অর্ধেক চালান করে হাল্কা হলুম। বাকীটা দিলুম সুজিতকে।


সুজিতের বাড়ী ছেড়ে গন্তব্য এবার  সেই মাইখানা যেখানে গালিব, ওমর খৈয়ামের মত গুণী জনেরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন।  আমরাও চললাম তাদের পথ ধরেই।  এবারও আড্ডা, তবে ঠোঁট ছুয়ে ছিল সিরাজীর পেয়ালা। তবে সুজিতের আজকাল বড়ই ছোয়াছুয়ির বাই , লিমকা ছাড়া কিছুই হাতে নেয়না। অবশ্য তার একটা কারণও আছে, যেটা সুজিতকে আরও দায়িত্বশীল করেছে।  তিন ঘন্টা তর তর করে কেটে গেল। আজকে অরুণ আর বড়ভাই বলরামেরও আসবার কথা ছিল।  বলরাম চারমাসের জন্য বিদেশে চলে যাবে তাই ব্যাস্ত,  শেষমুহূর্তের ব্যাস্ততা ফেলে আসতে পারল না। বলরাম না থাকলে আমাদেরও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সংসারের বড়ভাই না থাকলে যা হয়। একটা সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি ঘিরে থাকে ছোট ভাইদের ঘিরে।


আজ যখন জীবনে কি পেয়েছি বা পায়নি, তার হিসেব মিলাতে বসি, তবে দেখব পাওয়ার ঘড়াই পরিপূর্ণ।  বন্ধুর মত বন্ধুরা এসে হাত ধরেছে। অনেকেই বলে জীবনের পথ বন্ধুর।  কিন্তু বন্ধু যদি থাকে তাহলে কোন পথই বন্ধুর মনে হয় না।  একবার বর্ষার গঙ্গা সাঁতার দিয়ে পেরোতে গিয়ে গঙ্গার খরস্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম তখন আমার ছোটবেলার দামাল বন্ধু সতুই আমার রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছিল। তাই আজও এই পৃথিবীর বুকে ভেসে আছি। জীবনের সব পর্যায়ে বন্ধুত্বের হাতছানি ডাক দিয়েছে। অপু, পন্ডিত, ছোটে নবাব, পাপ্পু নবাব, আলিবাম, মীজানুর এরা সবাই সুধায় দিয়েছে ভরে এই জীবন,তাই এত সুন্দর এই পৃথিবী।   আজ হয়ত তারা অনেকেই ছিটকে গেছে।

কিন্তু বন্ধুর আসন অপুর্ণ থাকেনি। আমার বড় কালের বন্ধুদের তো অনেকেই চেনেন। সুজিত, পল্টা, অরুণ, বড়ভাই বলরাম, আরো অনেকেই। তাই জীবনপাত্র পরিপূর্ণ।  কোন অভাব নেই, অভিযোগ নেই। বন্ধুত্বের মাধুরীতে সব অভাব গেছে ধুয়ে মুছে।

আমার ছোটবেলা

 


আজ অস্তাচলের পথে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বড় মনে পড়ে। আমার শহর,আমার মা, আমার বাবা, ফেলে আসা ছোটবেলার বন্ধুদের কথা স্পষ্ট মনের পর্দাই ভেসে ওঠে। একেবারে জীবন্ত যেন কালকের দেখা ঘটনা। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া যাবে।কিন্তু তা তো নয় তাদের অনেকেই যে আজ অদৃশ্যলোকের বাসিন্দা। হাজারো ডাক। হাজারো হাহাকারেও তারা স্তব্দ হয়েই থাকবে। দেয়ালে টাঙানো ছবির মতই। 

আমার শহরের নাম অনেকেই জানেন মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ।জঙ্গিপুর মহকুমার সদরশহর। এখন জঙ্গীপুর আলাদা জেলা। আর রঘুনাথগঞ্জও আজ ডিস্ট্রিক্ট টাউন।  আমার স্মৃতিতে একটা ছোট্ট সুন্দর সাজানো শহর। কোর্টকাছারী,স্কুল কলেজ,অফিসপত্র সবই ভাগীরথির এইপারে অর্থাৎ রঘুনাথগঞ্জে আর ওপারে জঙ্গীপুর শহর। ধারে ভারে জঙ্গিপুর কিন্তু এ'পারের রঘুনাথগঞ্জের তুলনায় অনেক ছোট আর গুরুত্বহীন। তবে জঙ্গিপুর কলেজ কিন্তু জঙ্গিপুরেই। আমার দাদা,দিদিরা সবাই এই কলেজেই পড়ত। তখন পারাপারের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। সদরঘাটের খেয়া পার হয়ে যেত হত ওপারের জঙ্গীপুর কলেজে।

তো এই হচ্ছে আমার শৈশবের শহর রঘুনাথগঞ্জ।এইখানেই আমার জন্ম কোন এক বৈশাখের পঁচিশে।তারিখটা নিশয় চেনা চেনা লাগছে।সত্যি বলতে জীবনে এই একটা কাজই করেছি। পঁচিশের দড়ি ধরে ঝুলে পরতে পেরেছি। তাই তো সারাজীবন একটা পদ্যও না লিখে কেমন কবিগুরুর সঙ্গে ঝুলে রয়েছি।তবে কবিতা যে একেবারের লিখিনি তা তো নয়। প্রথম যখন একটা সুন্দরী কিশোরী মনের মধ্যে তোলপাড় তুলল তখন লিখেই ফেলেছিলাম। 'মঞ্জু তোমাকেই' লালবাগে জমিদারবাড়ির এক সুন্দরী কন্যার। সে অবশ্য একটু বড়কাল মানে সদ্য গোঁফ ওঠা বয়সের কথা। এ বয়সে ছেলেরা একটু এঁচোড়ে পাকা হয়। আমিও বাদ যাইনি। তো এসব কথা পরে আসবেখন। এখন শুনুন আমার ছোটবেলার ছোট কথা আর ছোট্ট শহর  রঘুনাথগঞ্জের কথা।আমাদের শহর বড় সুন্দর। ছোট্ট কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। এখনকার মত এত আবর্জনার রমরমা তখন দেখিনি। ময়লা না ছিল বাইরে না সেইসময়ের মানুষের মনের মধ্যে। আজ যখন সেইসময়ের মানুষদের কথা ভাবি, তাদেরকে যেন মনে হয় রুপকথার চরিত্র সব। এখনকার মানুষদের মত এত বিবর্ন বা স্বার্থপর নয়। 

এত সব ভাবতে ভাবতে বিষয় থেকে কখন গেছি সরে। যা বলছিলাম রঘুনাথগঞ্জ ভারী সুন্দর শহর। ভাগীরথির নদী বয়ে গেছে এর পাশ দিয়ে।এখানে আরো একটা ছোট নদী আছে, খড়খড়ী তার নাম। সে নদীতেও অনেক মাছ।একপাশে রঘুনাথগঞ্জ আর অন্যপারে জঙ্গীপুর।A tale of two cities এর মত ব্যাপার। একে অন্যের পরিপুরক।ভারী মৃদুছন্দে বয়েচলা জীবন। কোন ব্যস্ততা নেই। সবাই সবাইকে চেনে।তারা হয় কাকা,জ্যাঠা, দাদা, দিদি এইরকম আর কি। সবাই সবাইয়ের সাথে আত্মীয়তার ছন্দে বাধা। আমার তো অনেকটা Malgudi Days মত লাগে। আসলে আমাদের সবারই মালগুড়ী ডেস কোথাও না কোথাও আছে। সবার হয়ত মনে থাকে না। আমার থেকেই গেছে। কারণ আমি তো বড়ই হয়নি,ছোট্ট থেকে গেছি । সে যাইহোক আমার ছোট্ট শহরে কয়েকটা মাত্র পাড়া ছিল, খুব কাছাকাছি,ঘেষাঘেষী করে গুষ্ঠিসুখের ওম নিত সবাই। ওম কি জানেন না? এটা বোঝান খুব মুস্কিল নয়। আমার সাথে যদি আপনার দেখা হয় তাহলে ঠিক জেনে যাবেন।এবার শুনুন আমাদের পাড়াগুলোর নাম। আমাদের বাড়ী এখনও আছে ফাঁসীতলায়,(শুনে ভয় পাবেন না, আমরা অতি সজ্জন লোক, কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো আমাদের কম্ম নয়, সেসব হয়েছিল বৃটিশ আমলে,গোরা সাহেবরা কাকে ফাঁসি দিয়েচিল, সেইথেকেই এই নাম),পাঁকুড়তলা,সেখানে এখনো একটা পাঁকুড় গাছ আছে বা রয়েই গিয়েছে সেই স্বাধীনতার আগে থেকেই,বাজারপাড়া, দরবেশ পাড়া, ফুলতলা, সদরঘাট,ম্যাকেঞ্জী পার্ক,বেলেঘাটা আরো কিছু। শরৎ পন্ডিত মশাই কে মনে আছে নিশ্চয়, আরে দা’ঠাকুর।যার পন্ডিত প্রেস আজও আছে, আরে যেখান থেকে ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ আজও বেরোয়।শরৎ পন্ডিতের নামে দাদাঠাকুর সিনেমা হয়েছিল। ছবি বিশ্বাস করেছিলেন। তো দা'ঠাকুর ছিলেন আমার দুই বন্ধু রবি আর অনুত্তমের দাদু। আমি তো প্রায়ই তার বিছানার পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতুম। উনি যে এত নামকরা লোক তখন কি আর জানতুম, তবে তিনি নজরুলের কথা সুভাষের কথা অনেক বলতেন। এদের বাড়ীর কেউই কিন্ত জুতো বা চটী পরতেন না। জানিনা, সে রেওয়াজ এখন চালু আছে কিনা? জঙ্গিপুরের আর একজনকে অবশ্যি অনেকেই চিনবে, যদি সত্যজিতের সোনার কেল্লা দেখা থাকেন। তাতে ফেলুদার মুখে শুনবেন “এ তো আর জঙ্গীপুরের হরিশ পোদ্দার নয়, যে লাখ দুলাখ ফেলে দেবেন।“ 

মুস্কিল হল, রঘুনাথগঞ্জে সবাই সবাইকে চেনে, তাই কোন অপকর্ম করে নজর এড়িয়ে যাওয়া খুব মুশকিল ছিল। একবার ছোটবেলায় টিউশন ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলী সিনেমা দেখেছিলাম। শাম্মী কাপুর আর সায়রা বানুর ছবি, তখনকার দিনের খুব বিখ্যাত ছবি।ছোটকাকার চোখ এড়াতে পারি নি। ঠিক ধরা পরে গেলাম।অবশ্য তাতে ক্ষতি বিশেষ হয় নি। আমার ছোটকাকা আমাকের রিক্সা করে ছায়াবাণী সিনেমা হল থেকে নিয়ে গিয়েছিল।বাবার কানে তোলে নি, তুললে চড়চাপাটি পরতো নির্ঘাত।এ কথায় সেকথায় বড় দিকভ্রান্ত হয়ে পরছি। গুছিয়ে বলা হচ্ছে না কিছুই। তাই এবার শুরুর শুরু করি। তবে শুরুতে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি বোধহয় আমার ছোট বয়সে একটু সুদর্শনই ছিলাম।আমার বয়স তখন মাত্র ৮। আমার পাড়ার এক কাকার ইচ্ছে ছিল বড় হলে তার মেয়ে পাঞ্চালীর সংগে আমার বিয়ে দেবার। শুনে কি আনন্দই না হয়েছিল। তাই শুনে ডগমগ হয়ে বাড়ীতে ফিরেই পাউডার মেখে আমার সেই অপরুপ মুখ আয়নায় দেখে নিজেই চমৎকৃত হয়েছিলাম। ছবি আঁকতে জানলে সে ছবি আপনাদের দেখাতে পারতুম। তবে সে ছবি আমার মনের মণিকোঠায় জমা আছে আজও। পাঞ্চালীর সংগে আর দেখা হয়নি। কি জানি তাকে কোন অর্জুন নিয়ে গেছে? 


Monday, 1 April 2024

বেনারসী রাবড়ি

 লিট্টিসুন্দরী

 

"অভয় দাও তো বলি আমার Wish কি

এক ছটাক সোডার জলে,

পাক্কী তিন পোয়া হুইস্কী। "

                                 

                               

সত্যি বলতে আজ আমার ইচ্ছেটা সেইরকম মোটেই নয়, একেবারে অন্যরকম। এই গরমে  হুইস্কী মোটেই নয়।  আজ আমার ইচ্ছেটা ফুটে উঠেছে -লাল মুচমুচে রেশমি পরোটা  আর বেনারসি রাবড়ি মাখামাখি করে যেমনটি হয়, ঠিক তেমনি করে। বাকীটা ভেবে নিন। এই পরোটা যেমন তেমন নয়। এরকম পরোটা আর কাবাবের দোকান  দেখতে পাবেন ইলিয়ট রোড আর রিপন স্ট্রীটের দুপারেই। তবে এই গরমে কাবাবও বাদ দিয়েছি। তার বদলে আজ আমার পসন্দ বেনারসের রাবড়ি। 


বেনারসি রাবড়ির স্বাদ অনেকেই নিয়েছেন। যদি কেমন জিজ্ঞেস করি তবে হয়ত সবাই বলবেন, দারুণ, অপুর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাতে কি সব প্রকাশ পেল? একেবারেই নয়। তবে কেমন? বেনারসি রাবড়ি আমার বোধে হল কামনার মৃদু অগ্নিশীতল তাপে, সোহাগের সরে সরে, ভালবাসার মৃদু মন্দ মলয় সুবাসে, হৃদয়ে হাজারো ঘোড়সওয়ারের দাপাদাপি। এর সঙ্গে লাল লাল মুচমুচে পরোটা। যেন পৃথ্বীরাজ টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এসে বেনারসি সুন্দরীকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আদপে তা কি হল? একেবারেই নয়। আজ আমার টগবগানো রক্তের অনেকটা দিয়ে এসেছি ল্যাবে আমার শর্করার ঘনত্ব আরও সব সুচক মাপতে। যতক্ষণ না সে রিপোর্ট আসে ততক্ষণ কোন বাড়াবাড়িই বাড়তে দেওয়া নয়। অতএব এটা আজকে পোস্টপোন্ডই থাক। যেদিন হবে, সেদিন জানাব আপনাদের।


আজ বিষ্টু ঘোষের আখড়া থেকে বেরিয়েই বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেল। উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে উত্তম সব মিষ্টান্নের আয়োজন। নতুন নন্দ, পুরোন নন্দ, খগেনের দোকান আর তেলেভাজার অনন্ত অয়োজন।  কিন্তু সেখানে আমার ঢোকা বারণ। তাই আজ লিট্টিসুন্দরীতেই আত্মসমর্পণ।  সুকিয়া স্টীটের মোড়ে গরম গরম লিট্টি, আলুর চোখা আর চাটনি দিয়েই ভেতরের আগুনটাকে আয়ত্বে আনলাম।  একটু রাস্টিক, দেহাতী গন্ধ মাখা। কিন্তু গরম গরম বেশ লাগে। একদিন সেবা নিয়ে দেখবেন।