আজ অস্তাচলের পথে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বড় মনে পড়ে। আমার শহর,আমার মা, আমার বাবা, ফেলে আসা ছোটবেলার বন্ধুদের কথা স্পষ্ট মনের পর্দাই ভেসে ওঠে। একেবারে জীবন্ত যেন কালকের দেখা ঘটনা। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া যাবে।কিন্তু তা তো নয় তাদের অনেকেই যে আজ অদৃশ্যলোকের বাসিন্দা। হাজারো ডাক। হাজারো হাহাকারেও তারা স্তব্দ হয়েই থাকবে। দেয়ালে টাঙানো ছবির মতই।
আমার শহরের নাম অনেকেই জানেন মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ।জঙ্গিপুর মহকুমার সদরশহর। এখন জঙ্গীপুর আলাদা জেলা। আর রঘুনাথগঞ্জও আজ ডিস্ট্রিক্ট টাউন। আমার স্মৃতিতে একটা ছোট্ট সুন্দর সাজানো শহর। কোর্টকাছারী,স্কুল কলেজ,অফিসপত্র সবই ভাগীরথির এইপারে অর্থাৎ রঘুনাথগঞ্জে আর ওপারে জঙ্গীপুর শহর। ধারে ভারে জঙ্গিপুর কিন্তু এ'পারের রঘুনাথগঞ্জের তুলনায় অনেক ছোট আর গুরুত্বহীন। তবে জঙ্গিপুর কলেজ কিন্তু জঙ্গিপুরেই। আমার দাদা,দিদিরা সবাই এই কলেজেই পড়ত। তখন পারাপারের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। সদরঘাটের খেয়া পার হয়ে যেত হত ওপারের জঙ্গীপুর কলেজে।
তো এই হচ্ছে আমার শৈশবের শহর রঘুনাথগঞ্জ।এইখানেই আমার জন্ম কোন এক বৈশাখের পঁচিশে।তারিখটা নিশয় চেনা চেনা লাগছে।সত্যি বলতে জীবনে এই একটা কাজই করেছি। পঁচিশের দড়ি ধরে ঝুলে পরতে পেরেছি। তাই তো সারাজীবন একটা পদ্যও না লিখে কেমন কবিগুরুর সঙ্গে ঝুলে রয়েছি।তবে কবিতা যে একেবারের লিখিনি তা তো নয়। প্রথম যখন একটা সুন্দরী কিশোরী মনের মধ্যে তোলপাড় তুলল তখন লিখেই ফেলেছিলাম। 'মঞ্জু তোমাকেই' লালবাগে জমিদারবাড়ির এক সুন্দরী কন্যার। সে অবশ্য একটু বড়কাল মানে সদ্য গোঁফ ওঠা বয়সের কথা। এ বয়সে ছেলেরা একটু এঁচোড়ে পাকা হয়। আমিও বাদ যাইনি। তো এসব কথা পরে আসবেখন। এখন শুনুন আমার ছোটবেলার ছোট কথা আর ছোট্ট শহর রঘুনাথগঞ্জের কথা।আমাদের শহর বড় সুন্দর। ছোট্ট কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। এখনকার মত এত আবর্জনার রমরমা তখন দেখিনি। ময়লা না ছিল বাইরে না সেইসময়ের মানুষের মনের মধ্যে। আজ যখন সেইসময়ের মানুষদের কথা ভাবি, তাদেরকে যেন মনে হয় রুপকথার চরিত্র সব। এখনকার মানুষদের মত এত বিবর্ন বা স্বার্থপর নয়।
এত সব ভাবতে ভাবতে বিষয় থেকে কখন গেছি সরে। যা বলছিলাম রঘুনাথগঞ্জ ভারী সুন্দর শহর। ভাগীরথির নদী বয়ে গেছে এর পাশ দিয়ে।এখানে আরো একটা ছোট নদী আছে, খড়খড়ী তার নাম। সে নদীতেও অনেক মাছ।একপাশে রঘুনাথগঞ্জ আর অন্যপারে জঙ্গীপুর।A tale of two cities এর মত ব্যাপার। একে অন্যের পরিপুরক।ভারী মৃদুছন্দে বয়েচলা জীবন। কোন ব্যস্ততা নেই। সবাই সবাইকে চেনে।তারা হয় কাকা,জ্যাঠা, দাদা, দিদি এইরকম আর কি। সবাই সবাইয়ের সাথে আত্মীয়তার ছন্দে বাধা। আমার তো অনেকটা Malgudi Days মত লাগে। আসলে আমাদের সবারই মালগুড়ী ডেস কোথাও না কোথাও আছে। সবার হয়ত মনে থাকে না। আমার থেকেই গেছে। কারণ আমি তো বড়ই হয়নি,ছোট্ট থেকে গেছি । সে যাইহোক আমার ছোট্ট শহরে কয়েকটা মাত্র পাড়া ছিল, খুব কাছাকাছি,ঘেষাঘেষী করে গুষ্ঠিসুখের ওম নিত সবাই। ওম কি জানেন না? এটা বোঝান খুব মুস্কিল নয়। আমার সাথে যদি আপনার দেখা হয় তাহলে ঠিক জেনে যাবেন।এবার শুনুন আমাদের পাড়াগুলোর নাম। আমাদের বাড়ী এখনও আছে ফাঁসীতলায়,(শুনে ভয় পাবেন না, আমরা অতি সজ্জন লোক, কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো আমাদের কম্ম নয়, সেসব হয়েছিল বৃটিশ আমলে,গোরা সাহেবরা কাকে ফাঁসি দিয়েচিল, সেইথেকেই এই নাম),পাঁকুড়তলা,সেখানে এখনো একটা পাঁকুড় গাছ আছে বা রয়েই গিয়েছে সেই স্বাধীনতার আগে থেকেই,বাজারপাড়া, দরবেশ পাড়া, ফুলতলা, সদরঘাট,ম্যাকেঞ্জী পার্ক,বেলেঘাটা আরো কিছু। শরৎ পন্ডিত মশাই কে মনে আছে নিশ্চয়, আরে দা’ঠাকুর।যার পন্ডিত প্রেস আজও আছে, আরে যেখান থেকে ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ আজও বেরোয়।শরৎ পন্ডিতের নামে দাদাঠাকুর সিনেমা হয়েছিল। ছবি বিশ্বাস করেছিলেন। তো দা'ঠাকুর ছিলেন আমার দুই বন্ধু রবি আর অনুত্তমের দাদু। আমি তো প্রায়ই তার বিছানার পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতুম। উনি যে এত নামকরা লোক তখন কি আর জানতুম, তবে তিনি নজরুলের কথা সুভাষের কথা অনেক বলতেন। এদের বাড়ীর কেউই কিন্ত জুতো বা চটী পরতেন না। জানিনা, সে রেওয়াজ এখন চালু আছে কিনা? জঙ্গিপুরের আর একজনকে অবশ্যি অনেকেই চিনবে, যদি সত্যজিতের সোনার কেল্লা দেখা থাকেন। তাতে ফেলুদার মুখে শুনবেন “এ তো আর জঙ্গীপুরের হরিশ পোদ্দার নয়, যে লাখ দুলাখ ফেলে দেবেন।“
মুস্কিল হল, রঘুনাথগঞ্জে সবাই সবাইকে চেনে, তাই কোন অপকর্ম করে নজর এড়িয়ে যাওয়া খুব মুশকিল ছিল। একবার ছোটবেলায় টিউশন ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলী সিনেমা দেখেছিলাম। শাম্মী কাপুর আর সায়রা বানুর ছবি, তখনকার দিনের খুব বিখ্যাত ছবি।ছোটকাকার চোখ এড়াতে পারি নি। ঠিক ধরা পরে গেলাম।অবশ্য তাতে ক্ষতি বিশেষ হয় নি। আমার ছোটকাকা আমাকের রিক্সা করে ছায়াবাণী সিনেমা হল থেকে নিয়ে গিয়েছিল।বাবার কানে তোলে নি, তুললে চড়চাপাটি পরতো নির্ঘাত।এ কথায় সেকথায় বড় দিকভ্রান্ত হয়ে পরছি। গুছিয়ে বলা হচ্ছে না কিছুই। তাই এবার শুরুর শুরু করি। তবে শুরুতে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি বোধহয় আমার ছোট বয়সে একটু সুদর্শনই ছিলাম।আমার বয়স তখন মাত্র ৮। আমার পাড়ার এক কাকার ইচ্ছে ছিল বড় হলে তার মেয়ে পাঞ্চালীর সংগে আমার বিয়ে দেবার। শুনে কি আনন্দই না হয়েছিল। তাই শুনে ডগমগ হয়ে বাড়ীতে ফিরেই পাউডার মেখে আমার সেই অপরুপ মুখ আয়নায় দেখে নিজেই চমৎকৃত হয়েছিলাম। ছবি আঁকতে জানলে সে ছবি আপনাদের দেখাতে পারতুম। তবে সে ছবি আমার মনের মণিকোঠায় জমা আছে আজও। পাঞ্চালীর সংগে আর দেখা হয়নি। কি জানি তাকে কোন অর্জুন নিয়ে গেছে?
No comments:
Post a Comment