Saturday, 29 June 2024

যোধপুর টু জয়শলমীর

 ফেলুদারা পুরনো হয় না


যোধপুর টু জয়সলমীর 


তখন সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সবে দেখেছি। একে জাতিস্মর মুকুল সঙ্গে ফেলুদা, গ্লোব ট্রটার কামু মুখার্জি, লালমোহন বাবু, সর্বোপরি সোনার কেল্লা। সে এক জমজমাট ব্যাপার।  কামু মুখার্জি আমার খুব চেনা। দাপুটে অভিনেতা তো বটেই। তবে বাস্তবেও তিনি খুব দাপুটে ছিলেন। প্রায়দিনই সন্ধ্যাবেলায় তার সঙ্গে দেখা হত।  থাকতেন  ফুলবাগানের মোড়ে। তবে টপভূজঙ্গ অবস্থায়।  বাংলায় পুরো নিবেদিত। তখন যে সব সংলাপে গমগম  করতেন, তা লেখায় অসুবিধে আছে।  আর লালমোহন বাবু মানে সন্তোষ দত্ত থাকতেন  মানিকতলায়।  ছায়া সিনেমার পাশের গলিতেই তার বাড়ী। অনেকবারই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ দুএকবার তার সঙ্গে যেচে গিয়ে কথাও বলেছি। ভারী বিনয়ী ভদ্রলোক ছিলেন। বাকী রইল তপসে। তপসে কিন্তু শেয়ার বিশেষজ্ঞ। শেয়ারের উপর অনেক বইও আছে।  তো, তার কাছে ক্লাসও করেছি কিছুদিন।  ওই শেয়ার নিয়েও। যদিও সুবিধে করতে পারিনি মোটেই। তবে এসবই  নেহাৎই পরের কথা।   আর আমার এই যাত্রা অনেক আগের,  প্রায় বছর ত্রিশেক কি তারও আগে। শুধু জয়সলমীর অবশ্য নয়। পুরো রাজস্থানই। রাজস্থান  বরাবরই আমার প্রিয় রুট, আগ্রা হয়ে ভরতপুর ছুঁয়ে জয়পুর দিয়ে ঢোকা। এর উল্টোটাও অবশ্য হয়। তবে আগ্রার তাজমহল আর ফতেপুর সিক্রি ছুঁয়ে না ঢুকলে রাজস্থান দেখার রোমান্সের ভিতই তৈরি হয় না। রাজস্থান রাজারাজড়ার জায়গা। তাই সেখানে রাজার মতই যেতে হয়। না হলে আর রাজার মত সম্মান পাবেন কি করে? তো আমিও প্রথমবারে গিয়েছিলাম ওই প্রায় রাজার মতই। রাজত্ব ছিলনা ঠিকই  কিন্তু সঙ্গে সেঁটে ছিল দুই শালী।  রাজা শালীবাহন, ছিলেন না একজন?  


রাজস্থান  লম্বা ট্যুর। অনেক ঘোরা,অনেক খাওয়া আর অনেক গপ্প। কাজ কি ওতসবে।তার চেয়ে চলুন একেবারে জাম্পকাট করে চলে যায়, যোধপুর। যোধপুরের কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই।  এখানেই সার্কিট হাউসেই ফেলুদা ছিলেন না? আমরা অবশ্য উঠেছিলুম একটা হোটেলে।  কোন সে হোটেল,  সে নাম আর মনে নেই। তবে যোধপুর ষ্টেশনের কাছে একটা হোটেলে খাবার কথা মনে আছে। পুরো শাকাহারী। গরমাগরম রুটির উপর দরাজ হাতে দেশী ঘিউ মাখিয়ে, সবজী, আচার, অড়হর ডাল আর শেষে লস্যির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মনে হল, জীবনে আর চাওয়ার কিছুই নেই।

যোধপুরের ক্লোকরুমে মালপত্র রেখে উঠে বসলুম জয়সলমীর এক্সপ্রেসে। রিজার্ভেশন করাই ছিল প্রায় ঝাড়া হাত পা। ভোরে পৌঁছবে জয়সলমীর। অভিজ্ঞতার অভাব যে কি নিদারুণ তা বুঝলুম ট্রেন কিছু রাস্তা চলার পরেই। সব শীতবস্ত্র তো ক্লোকরুমে রেখে এসেছি। আর এদিকে ট্রেন  যত মরুভূমিতে ঢুকছে ততই শীত যেন জাপটে ধরছে। শোয়া থেকে উঠেবসা, দাঁড়ানো, শেষে কামরার এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতে করতেই ভোরভোর  পৌঁছে গেলুম জয়সলমীর।  ট্রেন থেকেই নেমেই,  সামনেই সেই সোনার কেল্লা। সেইসব দিনে বাঙালির মনে ফেলুদা, সোনার কেল্লা,লালমোহন বাবুকে নিয়ে যে রোমান্টিসিজম ছিল, তা আজকে আর বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমরা জমে গেলাম দস্তুরমতন। শীতে আর রোমান্সেও। 


 উটের দুধের ঘন চা সেও পেয়ে গেলাম স্টেশন চত্তরেই। তখন জয়সলমীরে এত হোটেল ছিলনা। ট্যুরিস্ট লজে জায়গাও হয়ে গেল। তখন হলিউডের এক সিনেমার শুটিং চলছিল।  তাদের লোকেই গোটা লজ ভর্তি। তো হল জয়সলমীর দর্শন ইত্যাদি।  সে সব সাতসতেরোতে যাচ্ছিনা। আসল চমক বা চমৎকার ফেরার পথেই। ট্রেনেই ফিরছি যোধপুর।  এবার অবশ্য দিনে দিনেই।  পোখরানের নাম তো সবার জানা। তখন অবশ্য এ নাম খুব পরিচিত ছিলনা। ছোট্ট স্টেশন।  স্টেশনের বাইরেও যে খুব জমজমাট, তা নয়। তবে আমাদের ট্রেনের স্টপেজ ছিল এক ঘন্টা।  একটু হেটে বাইরে আসতেই চোখে পরল ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান।  চমচম বানাচ্ছে একজন। সাদা গুড়ো ক্ষীরের আস্তরণ মাখা। এক একটা প্রায় কোলবালিশের মতই। আর স্বাদ। ব্যাস পুছিয়ে মত। পোখরানের  আনবিক বোমা বিস্ফোরণের বহু আগেই পোখরানের চমচমের স্বাদের বিস্ফোরণ, সে শুধু আমিই জানি, আর আজও সে স্বাদের অনুরনন আমার অনুভবের পরতে পরতে।  এ তো প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগের ঘটনা। এই বছর কয়েক আগেই আবার জয়সলমীর গিয়েছিলুম। ফেরার পথে পোখরানেও থেমেছি। শুধু  চমচমেরই জন্যেই। কিন্তু সেই স্বাদ আর ফিরে আসেনি। ৩০/৩৫ বছর আগে জীবনের যে স্বাদ ছিল তা আর ফিরবেই বা কি করে?

Wednesday, 26 June 2024

ভুবন সোম

 আজ নবমী

আজকের ছবি

ভুবন সোম


ন'দিন পেরোতে চললো। এখনো মৃনাল সেনের কোন ছবির কথাই আসেনি। তাই কি হয়? আজকের ছবি আমার বিশেষ ভালোলাগার ছবি মৃনাল সেনের, 'ভুবন সোম'!

এ ছবিও অনেক আগের দেখা। বোধহয় তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছোকরা। প্রায় ফাঁকা হলে আমি আর আমার পিসতুতো ভাই বাবলু বহরমপুরের কল্পনা সিনেমা হলে দেখেছিলুম। অনেকটাই ভুলে গিয়েছিলাম।  কিন্তু ভালো লাগাটা মনে বেশ ছাপ রেখে গিয়েছিল। তাই আজ আবার ইউ টিউবে এই ছবি দেখে নিলাম। ছোট ছবি। সাদা কালোয় ঝকঝকে ছবি,বোর হবেন না মোটেই, মুগ্ধ যে হবেন এ কথা বলতেই পারি। সেই সময়ে তিন তিনটে ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছিল এই ছবি। শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম, শ্রেষ্ঠ পরিচালক আর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আর ভুবন সোম কে জানেন? উৎপল দত্ত।  তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি সে বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। আর ছিলেন সুহাসিনী মূলে।ভারী মিষ্টি এক গুজরাটি গাঁয়ের বধুর চরিত্রে।


এ ছবি ভারতীয় চলচ্চিত্রে ন্যু ওয়েভের পথিকৃৎ। শ্যাম বেনেগাল তো তার অনেক পরে এসেছেন। যদিও ফিল্ম বোদ্ধা নয়, তবু্ও এ ছবির ট্রিটমেন্ট মুগ্ধ করেছিল।জাম্প কাট কি তা প্রথম এই ছবি দেখেই জানলাম।  ভারী মুগ্ধ করেছিল আমার মত আনপড় আদমীকেও। এ ছবির সরলতা, নিপুণ বুননী আবিষ্ট করে রাখবে যে কাউকে। এ ছবির থিম কিন্তু জীবনের একঘেয়েমি, সরলতা,সমবেদনা আর সহভাতৃত্বকে কে ঘিরেই।


মূল গল্পটা এইরকম। 

ভুবন সোম রেলের এক উচ্চপদস্থ অফিসার। সৎ, ভীষণ কড়া, কোন দুর্নীতিই তিনি বরদাস্ত করেন না।  রেলের কর্মীরা তাই তাকে নিয়ে সন্ত্রস্ত।  এই পরিচয় নিয়েই ভুবন সোমের প্রবেশ গুজরাটের কোন  এক গ্রামে পাখি শিকারের জন্যে। এখানেই তার দেখা গ্রামের বধু গৌরীর সাথে। গৌরীর সাহায্যেই তিনি পরিচিত হলেন প্রকৃতির মাঝে, পাখিদের সাথে। শহুরে জীবনের ধরাচূড়া ছেড়ে গ্রামের পোষাকে তিনি মিশে গেলেন  প্রকৃতির সাথে, পাখীদের সাথে, জীবনের সাথে। চিনতে পারলেন জীবনের সরলতাকে, বুঝতে পারলেন সমবেদনা, সহভাতৃত্বের মূল্য। ভুবন সোম পাখি শিকার করতে পারলেন কি, না, সেটা কোন প্রসঙ্গই নয়। তবে শহরে ফিরে এলেন এক অন্য ভুবন সোম। বড় সমব্যথী, মানুষের প্রতি জীবনের প্রতি।  দুর্নীতির দায়ে এক রেলের কর্মীকে তিনি দিয়ে দিলেন বেকসুর খালাস৷ জাম্পকাট করে যেন ফিরে এলেন তিনি জীবনের মূলস্রোতে।

Tuesday, 25 June 2024

চারুলতা

 কোন এক পূজোর সময় লেখা


আজ অষ্টমী

আজকের ছবি 

চারুলতা 


এবার পুজো হবে কি হবেনা,  তার ঠিক নেই আর আমি অষ্টমীর ঢাকে কাঠি দিয়ে দিলাম। এ অবশ্য আমার কৃতিত্ব নয়। এই অকাল বোধনের দায়  দায়িত্ব সবই দীপকের। আমি শুধু হুকুম তামিল করে গেছি। এর পাপ পূন্য কোন কিছুই আমি চাইনে, শুদ্ধা ভক্তি, সেও আমার নয়। ভক্তি তো unconditional surrender. আমরা মুকসুদাবাদের লোক, চিরকালের ঘাড়টেঁড়া। শির নেহারি নতশির ওই...  আর যার হয় হোক, ও আমাদের নয়। ভক্তির বদলে ভালোবাসা বরং ঢের ঢের ভালো।  তিরতিরে হাওয়ার মত ছুঁয়ে যাবে,বয়ে যাবে কিন্তু বেঁধে রাখবে না।


আজকের ছবি চারুলতা। একদিকে রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' আর তাকে নিয়ে সত্যজিতের আঁকা কবিতা সেলুলয়েডে। আমরা এ ছবি দেখেছি স্কুলে পড়তে৷ তখন বোধহয় ক্লাস টেনে লালবাগের নবাব বাহাদুর স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ধুম আড্ডা চলত। কখনও মতিঝিলে কখনো হাজারদুয়ারীর সিঁড়িতে  আর কখনো বা আমাদের স্কুলের বিরাট হোস্টেলে। আরও অজস্র কতো জায়গায়ই যে ছিল,তবে এতসব জেনে কাজ নেই আপনাদের। মূল কথা আড্ডা হত জমজমাট।নবাব ওমরাহ থেকে হরিপদ কেরাণীর ছেলে সবাই আমরা বন্ধু। বন্ধুদের মধ্যে কি কোন ওপর নীচ থাকে। বন্ধু সবাই এক একজন হীরের টুকরো। আড্ডার কিন্তু কোনদিনও ছুটি নেই। বরং ছুটির দিনে সকাল বিকেল দুবেলায়। ওই বয়সেই সিগারেট ফোঁকা শিখে নিয়েছিলাম। আমাদের প্রথম প্রেম চারমিনার। আমার বা আমাদের এই ব্যসনের গুরু ছিল, পাপ্পু নবাব। নবাব হলে কি হবে, এক নম্বরের বয়াটে ছোকরা।  শুধু সিগারেট ফোঁকাই নয় কত সব দুষ্টু দুষ্টু  ছড়াই যে শিখিয়েছিল, তা আর কহতব্য নয়।

তবে , চারুলতা দেখার পরেই কিন্তু চারমিনার হয়ে গেলো আমাদের আদরের  'চারু'! চারমিনার কে আদর করে এই নামেই ডাকতাম আমরা। এখন আর আমাদের সেই চারমিনারও নেই, নেই সেই আদরের ডাক, "আমার চারু আছে'!


এমন একটা ধ্রুপদী ছবির আলোচনায় শুধু ফক্কুড়ি করে গেলাম। আসলে এতো সব জ্ঞানগর্ভ আলোচনার রসদ মানে জ্ঞানই নেই আমার। দীপককে ট্যাগ করে দিলাম, আমি নিশ্চিত ও সেই খামতি টুকু ঠিক পূরণ  করে দেবে। দীপকে আমার ভারী বিশ্বাস।  তবে পরীক্ষার খাতায় কিছুই কি লিখতে পারব না। সাদা খাতা? কভি নেহি।


  এ ছবি সবাই দেখেছেন,

 কি? না দেখলে দেখে নিন ইউটিউবে। সুন্দর এক কবিতার মত।একাকিত্বের ছবি,ভালোবাসার ছবি। হয়ত নিরুচ্চার। শীতের নদীর মত, যার ছলছলে স্বচ্ছ জলের মতই, সব দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায়না। এ ছবি তেমনই অন্তত তাই আমার অনুভবে ধরা দেয়। ফিল্ম বোদ্ধারা কি বলবেন, তা জানি না। তবে ভারী well crafted, meticulous. এবার যখন আবার দেখলাম,মনে হল এতটা নিঁখুত হবার কি কোন প্রয়োজন ছিল? এ ছবির দুটো দৃশ্য কিন্তু ভারী মনে রাখার মত। শুরুতে মাধবীর বায়নাকুলার হাতে বাড়ীর জানালায় জানালায় ছুটে বেড়ানো, যা তার অসহায় একাকীত্বের প্রতিচ্ছবি।  আর শেষ দৃশ্য চারু আর ভূপতি এক ফ্রেমে হঠাৎ ফ্রিজ হয়ে যাওয়া।  ক্রমশ লং শট। নষ্টনীড় বোঝাতে আর কিছুর দরকারই ছিল না। এর বেশী কিছু বুঝে থাকলে আমাকে জানাবেন কিন্তু। অষ্টমীর পূজো শেষ,  এবার সন্ধি পূজার আয়োজনে লেগে পড়ি?

রিয়া

 গত কয়েকদিন ধরেই  ফেসবুক মেতেছিল ননীগোপালের দোলখেলা নিয়ে। সে যে কি রঙ্গ তামাসা হয়েছে, তা দুচোখ দিয়ে না দেখলে পেত্যয় হবে না। ফেসবুকেও তার কিছু আভাস দিয়েছি আমরা সবাই। অনেকেই দেখেছেন বুড়ো ধামড়াদের লীলাকীর্তন। 

তবে দোলের দোলন এবার শেষ হয়েছে। যে যার ঘরে গিয়েছে ফিরে। তবু মনে হলো এ সবের সামনে যারা আসেনি, পেছন থেকে এই বুড়োদের আবদার, চাহিদার জোগান যারা দিয়ে গেছে মুখে ম্লান হাসি নিয়ে, তাদেরও সামনে আসা দরকার।

প্রথমেই যার কথা মনে এলো সে রিয়া। রিয়া কিন্তু বেশ আধুনিক নাম। বড়লোকের আদুরে মেয়েরাই যে শুধু রিয়া হবে এমনতো নয়। আমাদের আজকের চরিত্র, রিয়া কিন্তু পিতৃমাতৃহীন। কোথায় না কোথায় অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে, সে কে বা জানে? রিয়া কিন্তু বাঙালী কোন মেয়ে নয়। রিয়া তামাং।  তামাং উত্তরবঙ্গের এক আদিবাসী প্রজাতির মেয়ে। যে দুদিন আমরা রেনীতে ছিলাম, আমাদের সব চাহিদার জোগান দিয়ে গিয়েছে  নিরন্তর।ভারী দু:খী মেয়ে, মুখ দেখলেই বড় মায়া জাগে। ওর সম্মন্ধে আমি এতকিছু জানতে পারতাম না যদি না ননী বলতো। রিয়া ননীর সাথে দীর্ঘ পথ হেঁটে গিয়েছিল রেলী বাজারে আমাদেরই কারুর এক জরুরী ওষুধের প্রয়োজনে। ননীর একটা বড় গুণ সবার সাথেই সহজভাবে মিশতে জানে। ওই দীর্ঘপথে ও রিয়ার ছোট্ট জীবনের বড় বড় দু:খের অংশীদার হয়ে গিয়েছিল।ননীর পিতৃহৃদয় সে দু:খের কথা শুনে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। ওই ছোট্ট বাজারে কি আর পাওয়া যায়? রিয়ার ছোট্ট দুটি হাত অজস্র চকোলেট দিয়ে সে ভরিয়ে দিয়েছিল।


এখানেই কিন্তু গল্পের শেষ নয়। ওপরে রিয়ার পাশে যাকে দেখছেন, সে রোনাল্ড। রোনাল্ড লেপচা। লেপচারাই দার্জিলিং এর আদত আদিবাসী। রোনাল্ড কি এমন করলো, যাতে রিয়ার দু:খের দিনের অবসান হলো? স্রেফ রোনাল্ড রিয়াকো ভাগাকে লে গিয়া থা। দুজনেই সাদী করেছে। কাজ করছে দুজনেই ওই রিসোর্টেই। আর উপরে যে পুঁচকেটার ছবি দেখছেন, ও জাস্টিন লেপচা। রিয়ার দেওর। রিয়ার শ্বশুরও ভারী ইয়োং আর ভালোমানুষ। আমাদের জন্যে পাহাড়ী নদীর মাছ ধরে এনেছিল। রিয়া আর জাস্টিন মিলে সে মাছও রান্না করে খাইয়েছিল এই ধেড়ে খোকাদের।  সেই রান্না ওদের ভালোবাসার গন্ধ আর ওমে ভরপুর। তার তুলনা শহরের নামী দামী রেঁস্তোরার  সাথে হতেই পারে না।  

আজ রিয়া সুখী।  ভালো বর ও ঘর পেয়েছে। রিয়ার শ্বশুরবাড়ীও রিয়াকে মেনে নিয়েছে। ওরা সবাই মিলে নিটোল এক ভালোবাসার ছবি। আপনারাও সবাই ওদের আশীর্বাদ করুন যাতে ওদের আগামী দিনের পথ প্রশস্ত হয়। হয়ত অভাব আছে, থাকবেও, তাও ওরা সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে চলুক। এর বেশী জীবনে আর কি বা, চাই?

Thursday, 20 June 2024

চলতে চলতে

 পুরনো  লেখা


চলতে চলতে


আজ কলেজ স্ট্রীট যেতে হয়েছিল একটি জরুরী কাজে।  জরুরী আবার জরুরী নয়ও।  ওই শ্রডিঙ্গারের বেড়ালের মতই অনেকটা। একটু বেরিয়ে পরার ছুতো। কিন্ত বাটার মোড়ে নেমে মনে হল এর থেকে জরুরী একটা কাজ বাকী রয়ে গেছে। দীপকবাবুর খবর নেওয়া। দীপক বাবুকে নিশ্চয় ভুলে জাননি এরমধ্যে। দীপক গুপ্ত, রামকৃষ্ণ কথামৃতের,কথাকার শ্রীম, মহেন্দ্র গুপ্তের প্রপৌত্র। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান। বহুদিন অবসর নিয়েছেন। আমার সাথে তার বিশেষ ভালবাসার/স্নেহের সম্পর্ক । কিন্তু বেশ কিছুদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।দোষ একতরফা আমারই। আজ তাই আমার জরুরী কাজ ছিল আগে তার খবর নেবার, তার সঙ্গে দেখা করার।

 লাহাদের বাড়ীগুলো পাশে রেখে এগোলাম, কথামৃত ভবনের দিকে। এই অঞ্চল আমার খুবই পরিচিত এবং প্রিয়।লাহাবাড়ী, দেবদের বাড়ী, মিত্রদের বাড়ী, দত্তদের বাড়ী এককালের বনেদীয়ানার কেষ্টবিষ্টু সব। আমাদের সাথে এদের যোগাযোগ ছিল খুবই নিবিড়।  পথে পরল ঠনঠনিয়া কালীবাড়ী। যদিও অবিশ্বাসী মানে বিশ্বাসের জোর খুজে পাইনে।  দেবদেবতা, গুরুস্থানীয়দের নিয়ে মস্করা করতে ছাড়ি না, তবুও অভ্যাস বসে একটা পেন্নামই ঠুকে দিলাম  মায়ের পায়ে।যতটা না দেবতা জ্ঞানে,তার থেকে পাশের বাড়ীর ঠাকরুন ভেবে। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ীতে ঘোষেদের অংশীদারি আছে। ঘোষবাড়ীর বউ কল্যাণী আমার বিশেষ প্রিয়পাত্রী ছিলেন এককালে।  মাকালীর প্রসাদী শাড়ী, প্রসাদ অনেক পেয়েছি হাত ভর্তি করে। আসলে ঠনঠনিয়াই তে তার ডাব চিনি দিয়ে মানত, কখনো কেশবের জন্য কখনো বা মথুরের তরে। যুক্তির জালে যতই তাদের উড়িয়ে দিই, হৃদয়ের টানে কি ভাবে যেন বাঁধা পরে যায় তাদের কাছে। তাই এই উত্তরেই আমার সব প্রশ্নের উত্তর আর সব ভালবাসা এই উত্তরকে ঘিরেই। এযে বেঙ্গল রেঁনেসার আতুড়ঘর, এর প্রতিটি ধুলিকণায় যে পবিত্র সেই সব মহাপুরুষদের নিত্য আসা যাওয়া। কে সেখানে নেই? রামমোহন, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ, কেশব। তাই এই উত্তর কলকাতার বাড়ীঘর, স্থাপত্য, রাস্তাঘাটে সবেতেই বাঙালি ঐতিহ্যের সোঁদা গন্ধ আমার প্রাণ মনকে আবিষ্ট করে রাখে।


শংকর ঘোষ লেনে ঢুকে , রঞ্জিতের সাথে দেখা হল। রঞ্জিত সিং, ব্যাবসায়ী। পানের দোকান থেকে আজ বিরাট ব্যবসার মালিক। এর পেছনে অবশ্য স্টেট ব্যাংকের একটা ভুমিকা আছে । রঞ্জিতের দোকান থেকে বেশী দূরে নয় কথামৃত ভবন। বিদ্যাসাগর কলেজ পেরিয়েই,পৌছে গেলাম কথামৃত ভবনে। চেনা বাড়ী,বহুবার এসেছি। একইরকম আছে। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠেই তার দেখা। তার চওড়া হাসি দেখেই মনে হল, আমাকে চিনতে তার একটুও সময় লাগেনি


দীপকবাবুর কথা শুনলেই বুঝবেন, ইনি কথামৃতর জীবন্ত সংস্করণ।  তিনি বলেন,আমি শুনি।  আমার আজেবাজের প্রশ্নের সন্দেহের  সস্নেহ উত্তর থাকে তার ভাঁড়ারে। তিনি মোটেই রামকৃষ্ণের চৌকিদারি বা খবরদারির মধ্যে নেই। তার এই সহজ ভাবটা আমার বেশ লাগে। আমিও কথা বলে আরাম পাই।কথায় কথায় কেটে গেল দুটি ঘন্টা। এবার রওনা দিলাম ইউনিভার্সিটির দিকে। তবে আসার আগে কথা দিতে হল, আবার আসব এবং খুব শিগ্রিই। এবার যখন যাব তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব, একলা যাবনা। পরিচয় হবে বাঙ্গালীর ইতিহাসের সঙ্গে।  ফেরার পথে এক চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠে পরলাম।ট্রামে চড়ার সাথে পুরোন কলকাতার ভারি মিলমিশ। আমার মেজাজের সাথে বেশ টুংটাং করে হেলেদুলে চলে। অযথা এত তাড়াহুড়োর কিই বা দরকার?  চলুক না এইভাবেই।

Saturday, 15 June 2024

 



কোন এক ঝকঝকে রোববারের কথা। আজ বন্দীদশায় সেইসব স্মৃতিই প্রাণের আনন্দ, বেঁচে থাকার রসদ।


কদম কদম বাড়ায়ে যা

খুসী সে গীত গায়ে যা


আজ রোববার, ইংরেজি ১৮ই আগষ্ট, বাংলা ১লা ভাদ্র, ১৪২৬ দিবা ৬ ঘটিকা মাহেন্দ্রযোগ। এতসব সত্যিই কি লেখার দরকার? আমি শ্রীমও নই আর কোন কথামৃতও লিখতে বসিনি। নেহাৎই আমার প্রলাপ বচন। ইচ্ছে হলে শুনতেও পারেন,না হলে কানে গুজুন তুলো।

আসলে এখন আমার রোজই রোববার। একই তিথি, একই নক্ষত্র আর যোগ? রোজই মাহেন্দ্রযোগ। আসলে প্রতিদিনই যে ২৪ ঘন্টায় হয় সে হিসেব আগে করিনি। তখন মনে হত আরও কয়েকঘন্টা দিনের হিসেবে জুড়লে বেশ হত। একটু ফেলে ছড়িয়ে চলতে পারতুম। কিন্তু এখন ২৪ ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড গুনে কাটাতে হয়। মোটামুটি দিনের বেশীর ভাগটাই ভরপুর টইটম্বুর করে রাখি। কিন্তু রোববারের এই দুপুরটায়  মন বড় উচাটন হয়৷ আজও তেমনই এক রোববার।  চার দেয়ালের এই বাঁধন থেকে মুক্তি চায় মন। ওই যে রবিবাবুর গানে আছে না, ' এই আকাশে মুক্তি আমার...' পাখা থাকলে উড়েও যেতাম। একবার সত্যি সত্যিই উড়েই গিয়েছিলাম।  সে অনেক অনেক দূরে। তখন আমি নিমতিতায় থাকি। বরদাচরণ মজুমদার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়। বিরাট যোগী,সাধক। আমাদের দেশ, কাঞ্চনতলায় বাড়ী।  তার প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন নিমতিতা স্কুলের হেডমাস্টার মশায় অনিল সান্যাল্। তার কাছে আমার যোগ ধ্যানের প্রথম পাঠ। তো ধ্যানেই একদিন জাস্ট উড়ে গেলাম। উড়ে গেলাম মানে জাস্ট টেক অফ করলাম, প্লেনের মতো নয়, রকেটের গতিতে। সে এক বিরাট অনুভূতি।  পৃথিবী,চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ছাড়িয়ে কোথায় যে যাচ্ছিলুম কি জানি। মোক্ষলাভ প্রায় হয়েই যাচ্ছিল।   চারিদিকে এতো মুমুক্ষু দেখছি, সবাই মোক্ষের জন্যে কেমন আঁকুপাঁকু করে। কাজ নেই আমার এমন মোক্ষের, এই মাটির পৃথিবীই আমার ভালো। আপনার ভালো হন, মন্দ হন, নেশাভাং  যাই করুন, আপনাদের সঙ্গই আমার সৎসঙ্গ। আর এ ব্যাপারে আমার গুরু সেই রবিবাবুই, 'মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন পরে, বাঁধা সবার কাছে।" তাই মাঝ রাস্তায় ব্রেক কষে পিছিয়েই ফিরে এলুম, এই আপনাদেরই কাছে। এই আকাশেই আমার মুক্তি, মুক্তি আমার ঘাসে ঘাসে, ধূলায় ধুলায়।  যথারীতি, সেই মুমুক্ষুই থেকে গেলাম। বড্ড শক্ত বাংলা হয়ে যাচ্ছে। মুমুক্ষু মানে মুক্তি পিয়াসী। তাই তো মাঝেমাঝেই বেড়িয়ে পড়ি পথে পথে, ধুলায় ধুলায়। উত্তরের ঠাকুর দেবতা নিয়ে একটা পদ্যও লিখে ফেলেছি, পড়ে বলুন তো কেমন হয়েছে:


দর্জি পাড়ার রকে

পায়ে পায়ে ঘুরি, উত্তরের সব গলি

পাড়ায় পাড়ায় রকের আড্ডা, হরেক কিসিম বুলি,

বাচ্চা,বুড়ো,যুবা - সবার আসন পাকা,

মাফ কারো নেই,সবার টিকি এইখানেতেই বাঁধা,

ওবামা বা পুতিন, হোক না ইয়েলৎসিন,

সমঝে চলেন সবাই এদের, রকের বিচার পাকা ।


উত্তরের এই বাঁকে, পুরনো সব স্মৃতির ঝাঁপি আজও খুলে ডাকে,

শঙ্খ, ঘন্টা, কাঁসর ধ্বনির মাঝে, পুরনো সব দেবালয়ে,

দেবতারা আজও ওঠেন জেগে, 

দেখতে যদি চাও, দেখতে তাদের পাবে আজও,

যদি ঠিক সময়ে যাও,

সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা মারেন সবে, দরজী পাড়ার রকে।


  সে যাই হোক তারপরেও অনেক চেষ্টাই করিছি, কিন্তু আর ইঞ্চি ছয়েকের বেশী উঠতে পারিনি। এটুকু শুনেই আপনারা হয়ত ভাবতেই পারেন,এ বেটা ঠিক টেনীদার গলি ঘুরে এসেছে আর টেনীদা ভর করেছে এই বেআক্কেলের মাথায়। 


সত্যি সত্যিই আজ মাহেন্দ্রযোগ ধরেই বেড়িয়েছি৷ বাসে ট্রামে নয় একেবারে পদব্রেজে। হাঁটতে আমার ভারী ভাল লাগে। আর আমার হাঁটার প্রিয় জায়গাও এই উত্তরে। ইচ্ছে ছিল দর্জীপাড়ার নতুনদার সাথে আড্ডা মেরে সন্ধ্যেটা কাটাব। কিন্তু হাজার ডাকাডাকিতেও তার সাড়া পেলুম না। হয়ত ভাগলপুরেই ভাগলবা হয়েছে শ্রীকান্তের খোঁজে। উত্তরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চললুম। উত্তরের গলিতে গলিতে দেবদেবীর অবস্থান। এখানে সন্ধ্যে হলেই কাঁসরঘন্টার ভারী মিষ্টি আওয়াজ। মানুষের এখনও অচলা বিশ্বাস তাদের ঠাকুর দেবতায়। এই বিশ্বাসের আড়ম্বরহীন আয়োজনে আমারও নীরব সমর্থন।  ধর্ম থাকুক সে একক বা সমবেত বিশ্বাসে। কিন্তু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে যেন তেড়ে না আসে। এইখানেই আবার রামকৃষ্ণ।  যত মত তত পথ। থাকুক না সব বিশ্বাস পাশাপাশি হাতে হাত রেখে তা হলে কি ভালই না হয়। আমারও খুব পছন্দের এই প্লুরালিস্টিক সমাজ। অনেক ধর্ম, অনেক ভাষা অনেক সংস্কৃতি সংসার সমাজ আলো করে এই প্রকৃতির মত তার নানা রঙ,রুপ, গন্ধ নিয়ে থাক। যাক সে সব ভাবের কথা। আমি নিতান্তই অ-ভাবী মানুষ। এসব নিয়ে বেশী কথা বলা আমায় মানায়ও না।

যাক নতুনদাকে ধরতে না পেরে এগিয়ে চললুম, শোভাবাজার রাজবাড়ীর পানে। ইচ্ছে আজকের সন্ধ্যেটা রাজামশায় স্বপন দেব মহাশয়ের সাথেই পানালাপেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণে বেরোলেও রাজামশাইকে ফোনে পেলুম না। রাজবাড়ীর ফটক ঠেলে ঢুকে পড়তেই পারতুম। কিন্তু আমিও তো নবাব বাদশার দেশেরই লোক। এরকম বেয়াদব আচরণ কি আমার শোভা পায়? তাই চরৈবতিই। শেষে নেতাজির দোরগোড়ায় এসে থামতেই হল। পাঁচমাথার মোড়ে কালীমার দর্শন সেরে আদি হরিদাস মোদকের বিখ্যাত দোকানে নুচি সন্দেশ খেয়ে আবার সেই সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে। পুর্নমুষিক ভব।

 No one writes to the colonel


আজ সেই অর্থে, সকাল থেকে আমার করার কিছুই ছিলনা। রোজকার আসন, প্রাণায়াম আর ধ্যানে কেটে যায় ঘন্টা দুয়েক। তারপর,  আছে তো কিছু নিশ্চয়। না হলে বিরস দিন বিরল কাজ কি করে কাটবে। ছোট্ট একটা কাজ থাকে, সেটাতেও মন সংযোগ আর মাথা খাটানোর বেশ একটা ব্যাপার থাকে। সেটাতে আপাতত বিরতি চলছে। অবশ্য অল্প কয়েকদিনের জন্যেই।সেটা এসে গেলে আর বোর হবার মতো কোন ব্যাপার থাকবে না। নাতি পুতিরা স্কুলে। ওদের এখন ইউনিট টেস্ট চলছে, তাই নিয়ে ওরাও মহাব্যস্ত। কুন্তলাও গেছে মেদিনিপুরে। উত্যক্ত করার কেউ নেই। যারা একটু ভক্ত টাইপের বা ভয় পান, ভগবান, ভূতে বা বউয়ে, তারা অবশ্যই ওফেন্স নিতে পারেন, আমার উত্যক্ত কথার প্রয়োগে। আচ্ছা বলুন তো, জীবনের এই এতটা পথ হেঁটে এসে বউকে যদি উৎপাত না ভাবি, তাহলে কি ভাবব? আমার পাড়ার এক বন্ধু, নামটা বলেই ফেলি গৌতম,বউয়ের ভয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বসল। গৌতমকে তিন মাসের রিলিফ দিয়ে, দিল্লিতে কাটিয়ে এলেন তিনি, তিন তিনটি মাস। এখন তিনি এসে গেছেন। আর গৌতমের এখন ইরেগুলার হার্টবিট আর হাই ফিভার চলছে। আমি অবশ্য সে গোত্রের নয়। জানেন তো আমি মূর্শিদাবাদী, নবাবের দেশের লোক। ' শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির'। যাকগে ওসব কথা, তার থেকে বরং গল্প করি বা কিছু ইন্টেলেকচুয়াল আলোচনাই চলুক না।


আমরা তখন লালবাগে। ক্লাস নাইন? মনে একটা প্রেম প্রেম ভাব জাগছে।যাকে দেখি তারই প্রেমে পড়ি। এরকম একটা টালমাটাল চলছে। সে সময়ই ক্যাচ কট কট। প্রেম নয়। বিপ্লব। পড়লাম তুষারের খপ্পরে। নাম লেখালাম ছাত্র ফেডারেশনে সেই স্কুল বেলাতেই। তুষারের বাড়ীতেই শনিবার মিটিং হতো। জনগান্ত্রিক বিপ্লব, পেটী বুর্জোয়া,  দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ ইত্যাদি।  এছাড়াও আমাদের একটা জমজমাট আড্ডা বসতো, হাজারদুয়ারীর মাঠে। সেটা অবশ্যই বেশ কসমোপলিটান আসর। তাতে যেমন থাকতো, জামা নবাব, পাপ্পু নবাব, অপু, পন্ডিত, মীজানুর, রবি, সোনা, নিশিথ এরা। সেসব আলোচনা মূলতো সাহিত্যকেন্দ্রিক। আমাদের সাহিত্যমুখী করে তোলার পেছনে লালবাগের 'বান্ধব সমিতি'র প্রচুর অবদান ছিলো। অফুরন্ত বইয়ের জোগান দিয়ে গেছে এই লাইব্রেরি।  সে সময়ের হট ক্রেজ ছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলি।আমাদের বিকেলের আসরে সে সব ঘুরে ঘুরেই আসতো।


এসব তো সব আগের জন্মের কথা।খুব প্রিয়, খুব কাছের, কিন্তু তাদের আজ না যায় ধরা না যায় ছোঁয়া। সব স্মৃতির জগতেই থেকে গেছে, ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। আর জানেনই তো আমি একটু স্মৃতিকাতর মানুষ।  পুরনো দিন আমাকে হন্ট করে খুব। পুরনো দিন অনেকটাই পরাবাস্তবের মতোই। ম্যাজিক রিয়েলিজম যারে কয় পরিষ্কার ভাষায়।


আজকেই সেই ম্যাজিক রিয়েলিজমের গপ্প বসানোর তাল খুঁজছিলাম এতক্ষণ।  বাজে কথায়, ফেসবুকের বেশ কয়েকটা পাতা নিশ্চয় নষ্ট করে ফেলেছি। এখন আর কি? শর্টকার্টে সারি বরং। আমার সংগ্রহে প্রচুর বই আছে।  বইকেনা আমার একটা বদভ্যাসও বলতে পারেন।তবে সব বইও যে পড়ে ফেলেছি, এমন দাবী করব না মোটেই। তবে বেশকিছুই পড়েছি।


আমার যা মানসিক গঠন, তাতে ওই ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাপারটা বেশ যায় বাস্তবের জমির উপর দাঁড়িয়ে কল্পজগত তৈরী করা। ব্যাপারটা এককথায় এমনই। আর সেটাই আমার প্যাসটাইম। এবার বলুন তো, ম্যাজিক রিয়েলিজমের সেরা লেখক কে, অবশ্যই গাব্রিয়েল গ্রাসিয়া মার্কুয়েজ। যার ডাক নাম ছিল গাব্বো।কলম্বিয়ান লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক আরো কতো কি। জীবনের বেশীরভাগটাই কাটিয়েছেন মেক্সিকো আর ইউরোপের নানা দেশে। নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। তার অসামান্য সাহিত্যকীর্তির জন্যে। তার লেখা কতগুলো বউ, ' হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড', 'লাভ এট দি টাইম অফ কলেরা', ল্যবিরিন্থ, নো ওয়ান রাইটস টু কলোনেল' 'স্ক্যান্ডাল অফ দি সেঞ্চুরী' ইত্যাদি ইত্যাদি।  ওনার বহু বইই আমার সংগ্রহে আছে। আজ কোন কাজ নেই, তাই ডিম্ভাত ( মুরগীর নয় হাঁসের) খেয়ে বসে পড়েছি, কলোনেল কে নিয়ে।


ছোট্ট বই। চরিত্রও কয়েকজন। কলোনেল, তার অসুস্থা স্ত্রী, মৃত পুত্র, শহরের এক খ্যাতনামা গায়কের ফিউনেরাল, একটা লড়াইয়ের মোরগ,এক দয়ালু ডাক্তার যিনি কলোনেল আর তার স্ত্রীকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেন। একটা ষ্টীমার আর পোস্টম্যান।  প্রতি শুক্রবার জাহাজ আসে আর জাহাজে আসে ডাক।কলোনেল' জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে থাকেন মেলের প্রতীক্ষায়,  যে ডাকে তার প্রতিশ্রুত পেনশনের চেক আসবে।দীর্ঘ ১৫ বছর প্রতীক্ষার পরেও কলোনেলের সে চিঠি আসে না। পোস্টম্যান ঘোষণা করেন No one writes to Colonel.

সংক্ষেপে এটাই সারাংশ।  এক অসামান্য  না ছোটগল্প না উপন্যাস। সুযোগ পেলে বইটা পড়ে নেবেন একবার।

Wednesday, 5 June 2024

আম দরবার

 বোধিলাভ ও ডায়াবেটিস 


এবার গেল গেল, নেই নেই করেও কিন্তু আমকে ঠেকানো যায় নি। লিচু,আম, জামে বাজার ভর্তি শুধু নয় জমজমাট।  যেদিক পানেই তাকাও এর সুরত আর খুশবু ঠিক চোখ টেনে নেবে। আম অনেকটা সুন্দরী নারীর মত। যতই চোখ ঘুরিয়ে থাক আড়চোখে একবার তাকাবে না, এমন বিশ্বামিত্র তুমি নও। গাড্ডায় ঠিক পড়বে একদিন।  মেনকা, অপ্সরাদের মত রুপবতী, রসবতীরা তোমার অপেক্ষায় আছে। শুধু ঝোলায় ভরার অপেক্ষায়। 


আর আমার সাথে আমের প্রেম সে তো কোন শৈশব আর কৈশোর থেকেই।  আম, লিচুর মরসুমে আমাদের আর  অন্য কিছুর প্রয়োজন হত না। মুর্শিদাবাদের নবাবের বাগানের আম খেয়ে কৈশোর কেটেছে। সে বড় খুশবুদার, দিলদার সময় ছিল। কৈশোরের প্রেমে অভিশাপ থাকে।  থাকে হয়ত। না হলে এবার আমি এক চিলতে আমেরও সঙ্গ করিনি। যদিও আমার আসা যাওয়ার পথে শুধু আম আর আম। সুকিয়ায়, রাজাবাজার, কলেজস্টীট বাজার, ফুলবাগান সব আমের গন্ধে মাতোয়ারা।  তবে আম, লিচু কেনায় আমার ছেদ ঘটেনি একটুও। আমার নাতি, নাতনিও ভারী ভক্ত আমের। তাই আম আমি অবিরাম যোগান দিয়েই চলেছি। এতেই ভারী তৃপ্তি। আপনারাও খান। হাপুস,হুপুস করে খান। যত চান তত খান,কিছু হবে না যদিনা আপনার নিজের মিষ্টি অধিক না হয়ে থাকে। হলে কিন্তু কন্ট্রোল কন্ট্রোল।  কোন রসেই গলবেন না। 


আম নিয়ে আমার এবারের সংযমে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। এত ত্যাগ,তিতিক্ষা, সংযম, এ তো অসামান্য। এখন যদি কোন বটবৃক্ষের তলে দুচোখ মুদে বসে পরি, তবে আমার বোধিলাভ অনিবার্য। ভাবছি বসেই পরি, এই রাম  আর কালীর দ্বন্দ্ব  নিয়ে রাজ্যজুড়ে যে অশান্তির ঘনঘটা তাতে নতুন বুদ্ধের ভারী প্রয়োজন। আপনাদের সবার নেমন্তন্ন রইল। আমের মরশুম শেষ হলে দলে দলে চলে আসবেন, আমার দরবারে। একটাই শুধু মন্ত্র জপবেন, " বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি....আমিই নতুন বুদ্ধ।

Sunday, 2 June 2024

দালমা না দলমা

 দালমায় কিছুক্ষণ


আজ গিয়েছিলাম দালমা। কি মনে হচ্ছে? হাতীদের সাথে গল্পগুজব করতে। মোটেই নয়। এতো সাহস আমার কোনদিন ছিলনা আর হবেওনা কোনদিন। আর আমিও কোন প্রকৃতেশ বড়ুয়া নয়, যে হাতীদের ভালোবেসে চিরজীবন জঙ্গলেই কাটিয়ে দেব। শুনেছি, তিনি নাকি হাতীদের সাথে কানে কানে কথাও বলতেন। পাগল আর কি। ও কম্ম কি আমার পোষায় না সাজে।  তা ছাড়া হাতীরা তো প্রায়ই আসে ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের জঙ্গলে। সেখানে যাওয়া যেতেই পারে, যদি ইচ্ছে হয়। এই কয়েকমাস আগেই তো গিয়েছিলাম গুড়গুড়িপাল জঙ্গলে ননীর সাথে, হাতী কে সাথী করার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু হাতী কথা রাখে নি। আসলে,কেউ কথা রাখে না। বলেই তো গেছেন সুনীল তার সেই মন কেমন করা কবিতায়।


তাছাড়া আমি এখন আছি পুরীতে।  এখান থেকে দলমা অনেক দূর। কাছাকাছি বরং পুরীতেই খুঁজে দেখা যাক। নিশ্চয় পেয়ে যাবো। লিপুকেই বরং পাত্তা নিতে বলি। লিপু আমাদের হলিডে হোমের এক হোনহার লেড়কা। ও সব জানে। কোথায় সেই দালমা? 

খোঁজ পাওয়াও গেল। কাছেই একদম হাঁটা দূরত্বে। টুকটুকে গেলে মাত্র ৫০। কিমিতে নয় টাকায়।


বেড়িয়ে পড়লাম দালমার উদ্যেশে।  হেঁটে নয়, টুকটুকেই টুকটুক করে। আর পৌঁছেও গেলাম অল্প সময়েই। এবার বুঝলেন তো দালমার রহস্য। না? তাহলে আরো খুলে বলতে হবে। অগত্যা, কি আর করা।


'দালমা' একটা ওড়িয়া খাবারের রেঁস্তোরা বলুন হোটেল বলুন, তাইই।

'দালমা' উড়িষ্যার এক বিখ্যাত ডেলিকেসি। কি বলুন তো?  ডাল আর তার সাথে প্রচুর সবজী দিয়ে একটা চমৎকার প্রিপারেশন। দারুণ স্বাদ। আমার ঠাকুমার নিত্য রান্নায় এ পদ থাকতোই। সে বুড়ীর রান্নায় এতো স্বাদ ছিল যে আমরা সব ভাই বোনেরা হত্যে দিয়ে বসে থাকতাম তার রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। ভেতরে ঢোকা ছিলো বারণ। রান্না শেষে, বুড়ী এক এক দলা  আলগোছে ফেলে দিতো আমাদের বাড়ানো হাতে। আর তার যে কি স্বাদ, সে বলে বোঝানই যাবে না।


পুরীতে যতবারই আসি, ততবারই খাওয়া সারি ভজহরি মান্না, কস্তুরী, ষোল আনা বাঙালী এইসব জায়গাতেই। বাঙালী খাবারের ছকের বাইরে যাইনি খুব বড় একটা। তবে আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছি একটু একটু করে। এর আগে চ্যাঙ ওয়াকে ঢুকিয়ে নিয়েছি, আমাদের পুরীর রুটিনে।


এবার নতুন এন্ট্রি 'দালমা' র। বেশ হোটেল। চমৎকার রান্না। কলকাতার লোকেদের বেশ পরিচয় আছে, ওড়িয়া ঠাকুরের রান্নার সাথে। আমাদের বাড়ীর কাজেও আসে একজন। নাম গোকুল, কিন্তু ইয়ার্কি করে সবাই ডাকে হোকুল বলে। এ ভারী অন্যায়। তবে গোকুলের হাসিমুখ ব্যাজার হয় না মোটেই এইসব ঠাট্টা তামাসায়। 

 

বড্ড আজেবাজে কথা লিখে ফেলছি। সময় নষ্ট করছি আপনাদের। আসলে বাইরে এখন বেশ রোদ। বেড়োতে দেরী।  তাই নিজের বোরনেস কাটাতে আপনাদের বোর করি বরং কিছুক্ষণ। আমার টার্গেট অডিয়েন্স তো সেই সব কাজকর্ম শিকেয় তোলা পেনশনাররাই।এটা একরকম সাহায্যই করবে তাদের, বিষে বিষক্ষয়ের মতো।


এবার ডালমায় কি খেয়েছি বলি। যদি কলকাতার উড়িয়া ঠাকুরদের রান্না খাবারের দিয়ে বিচার করেন, তাহলে ঠকে যাবেন বিলক্ষণ।  খাঁটি ওড়িয়া খাবার স্বাদে গন্ধে কি বলবো? It's differert, Boss. Really different. আমরা অবশ্য ওদের বিখ্যাত পাঁখাল খাই নি। পাঁখাল হলো আমাদের পান্তাভাত। দেখলাম ওখানে অনেকেই পাঁখাল খাচ্ছে। সঙ্গে অনেকরকম সবজী, মৌরলার ঝাল ইত্যাদি।  আমরা একটু সেফই খেললাম। প্রথমবার তো।তবে সুগন্ধী চালের ভাতের সাথে অবশ্যই ছিলো দালমা, ওটাই সিগনেচার আইটেম। তার সাথে শাক আরো সব সাত সতোরো অনেক কিছু । টক টক, মিঠে মিঠে, বেশ স্বাদ।  আর আ লা কার্ত মেনু থেকে মাছ আর মাংস। পরিশেষে অবশ্যই পরমান্ন, ওড়িয়া মেনুর একটা বৈশিষ্ট্য।  কেমন খেলাম? বেশ খেলাম, পরিতৃপ্তি করে খেয়ে ফেরলাম দুজনে, আমি আর কুন্তলা।  কুন্তলা কে? এতোবছর পরে আবার বলতে হবে। ওই আর কি,  কমলি নেহি ছোঁড়তা। 😁


তাহলে ওই কথাই রইলো।  আপনাদের পুরীর মেনুতে  নতুন সংযোজন হোক এবার থেকে লী রোডের  ' চ্যাং ওয়ার' পরে ভি আই পি রোডের 'দালমা'!