যোধপুর টু জয়সলমীর
তখন সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সবে দেখেছি। একে জাতিস্মর মুকুল সঙ্গে ফেলুদা, গ্লোব ট্রটার কামু মুখার্জি, লালমোহন বাবু, সর্বোপরি সোনার কেল্লা। সে এক জমজমাট ব্যাপার। কামু মুখার্জি আমার খুব চেনা। দাপুটে অভিনেতা তো বটেই। তবে বাস্তবেও তিনি খুব দাপুটে ছিলেন। প্রায়দিনই সন্ধ্যাবেলায় তার সঙ্গে দেখা হত। থাকতেন ফুলবাগানের মোড়ে। তবে টলমলে অবস্থায়। বাংলায় পুরো নিবেদিত। তখন যে সব সংলাপে গমগম করতেন, তা লেখায় অসুবিধে আছে। আর লালমোহন বাবু মানে সন্তোষ দত্ত থাকতেন মানিকতলায়। ছায়া সিনেমার পাশের গলিতেই তার বাড়ী। অনেকবারই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ দুএকবার তার সঙ্গে যেচে গিয়ে কথাও বলেছি। ভারী বিনয়ী ভদ্রলোক ছিলেন। বাকী রইল তপসে। তপসে কিন্তু শেয়ার বিশেষজ্ঞ। শেয়ারের উপর অনেক বইও আছে। তো, তার কাছে ক্লাসও করেছি কিছুদিন। ওই শেয়ার নিয়েও। যদিও সুবিধে করতে পারিনি মোটেই। তবে এসবই নেহাৎই পরের কথা। আর আমার এই যাত্রা অনেক আগের, প্রায় বছর ত্রিশেক কি তারও আগে। শুধু জয়সলমীর অবশ্য নয়। পুরো রাজস্থানই। রাজস্থান ঢুকতে বরাবরই আমার প্রিয় রুট, আগ্রা হয়ে ভরতপুর ছুঁয়ে জয়পুর দিয়ে ঢোকা। এর উল্টোটাও অবশ্য হয়। তবে আগ্রার তাজমহল আর ফতেপুর সিক্রি ছুঁয়ে না ঢুকলে রাজস্থান দেখার রোমান্সের ভিতই তৈরি হয় না। রাজস্থান রাজারাজড়ার জায়গা। তাই সেখানে রাজার মতই যেতে হয়। না হলে আর রাজার মত সম্মান পাবেন কি করে? তো আমিও প্রথমবারে গিয়েছিলাম ওই প্রায় রাজার মতই। রাজত্ব ছিলনা ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সেঁটে ছিল দুই শালী। রাজা শালীবাহন, ছিলেন না একজন?
রাজস্থান লম্বা ট্যুর। অনেক ঘোরা,অনেক খাওয়া আর অনেক গপ্প। কাজ কি ওতসবে।তার চেয়ে চলুন একেবারে জাম্পকাট করে চলে যায়, যোধপুর। যোধপুরের কথা মনে পরে নিশ্চয়ই। এখানেই সার্কিট হাউসেই ফেলুদা ছিলেন না? আমরা অবশ্য উঠেছিলুম একটা হোটেলে। কোন সে হোটেল, সে নাম আর মনে নেই। তবে যোধপুর ষ্টেশনের কাছে একটা হোটেলে খাবার কথা মনে আছে। পুরো শাকাহারী। গরমাগরম রুটির উপর দরাজ হাতে দেশী ঘিউ মাখিয়ে, সবজী, আচার, অড়হর ডাল আর শেষে লস্যির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মনে হল, জীবনে আর চাওয়ার কিছুই নেই।
যোধপুরের ক্লোকরুমে মালপত্র রেখে উঠে বসলুম জয়সলমীর এক্সপ্রেসে। রিজার্ভেশন করাই ছিল প্রায় ঝাড়া হাত পা। ভোরে পৌঁছবে জয়সলমীর। অভিজ্ঞতার অভাব যে কি নিদারুণ তা বুঝলুম ট্রেন কিছু রাস্তা চলার পরেই। সব শীতবস্ত্র তো ক্লোকরুমে রেখে এসেছি। আর এদিকে ট্রেন যত মরুভূমিতে ঢুকছে ততই শীত যেন জাপটে ধরছে। শোয়া থেকে উঠেবসা, দাঁড়ানো, শেষে কামরার এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতে করতেই ভোরভোর পৌঁছে গেলুম জয়সলমীর। ট্রেন থেকেই নেমেই, সামনেই সেই সোনার কেল্লা। সেইসব দিনে বাঙালির মনে ফেলুদা, সোনার কেল্লা,লালমোহন বাবুকে নিয়ে যে রোমান্টিসিজম ছিল, তা আজকে আর বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমরা জমে গেলাম দস্তুরমতন। শীতে আর রোমান্সেও।
উটের দুধের ঘন চা সেও পেয়ে গেলাম স্টেশন চত্তরেই। তখন জয়সলমীরে এত হোটেল ছিলনা। ট্যুরিস্ট লজে জায়গাও হয়ে গেল। তখন হলিউডের এক সিনেমার শুটিং চলছিল। তাদের লোকেই গোটা লজ ভর্তি। তো হল জয়সলমীর দর্শন ইত্যাদি। সে সব সাতসতেরোতে যাচ্ছিনা। আসল চমক বা চমৎকার ফেরার পথেই। ট্রেনেই ফিরছি যোধপুর। এবার অবশ্য দিনে দিনেই। পোখরানের নাম তো সবার জানা। তখন অবশ্য এ নাম খুব পরিচিত ছিলনা। ছোট্ট স্টেশন। স্টেশনের বাইরেও যে খুব জমজমাট, তা নয়। তবে আমাদের ট্রেনের স্টপেজ ছিল এক ঘন্টা। একটু হেটে বাইরে আসতেই চোখে পরল ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান। চমচম বানাচ্ছে একজন। সাদা গুরো ক্ষীরের আস্তরণ মাখা। এক একটা প্রায় কোলবালিশের মতই। আর স্বাদ। ব্যাস পুছিয়ে মত। পোখরানের আনবিক বোমা বিস্ফোরণের বহু আগেই পোখরানের চমচমের স্বাদের বিস্ফোরণ, সে শুধু আমিই জানি, আর আজও সে স্বাদের অনুরনন আমার অনুভবের পরতে পরতে। এ তো প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগের ঘটনা। এই বছর কয়েক আগেই আবার জয়সলমীর গিয়েছিলুম। ফেরার পথে পোখরানেও থেমেছি। শুধু চমচমেরই জন্যেই। কিন্তু সেই স্বাদ আর ফিরে আসেনি। ৩০/৩৫ বছর আগে জীবনের যে স্বাদ ছিল তা আর ফিরবেই বা কি করে?
তখন সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সবে দেখেছি। একে জাতিস্মর মুকুল সঙ্গে ফেলুদা, গ্লোব ট্রটার কামু মুখার্জি, লালমোহন বাবু, সর্বোপরি সোনার কেল্লা। সে এক জমজমাট ব্যাপার। কামু মুখার্জি আমার খুব চেনা। দাপুটে অভিনেতা তো বটেই। তবে বাস্তবেও তিনি খুব দাপুটে ছিলেন। প্রায়দিনই সন্ধ্যাবেলায় তার সঙ্গে দেখা হত। থাকতেন ফুলবাগানের মোড়ে। তবে টলমলে অবস্থায়। বাংলায় পুরো নিবেদিত। তখন যে সব সংলাপে গমগম করতেন, তা লেখায় অসুবিধে আছে। আর লালমোহন বাবু মানে সন্তোষ দত্ত থাকতেন মানিকতলায়। ছায়া সিনেমার পাশের গলিতেই তার বাড়ী। অনেকবারই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ দুএকবার তার সঙ্গে যেচে গিয়ে কথাও বলেছি। ভারী বিনয়ী ভদ্রলোক ছিলেন। বাকী রইল তপসে। তপসে কিন্তু শেয়ার বিশেষজ্ঞ। শেয়ারের উপর অনেক বইও আছে। তো, তার কাছে ক্লাসও করেছি কিছুদিন। ওই শেয়ার নিয়েও। যদিও সুবিধে করতে পারিনি মোটেই। তবে এসবই নেহাৎই পরের কথা। আর আমার এই যাত্রা অনেক আগের, প্রায় বছর ত্রিশেক কি তারও আগে। শুধু জয়সলমীর অবশ্য নয়। পুরো রাজস্থানই। রাজস্থান ঢুকতে বরাবরই আমার প্রিয় রুট, আগ্রা হয়ে ভরতপুর ছুঁয়ে জয়পুর দিয়ে ঢোকা। এর উল্টোটাও অবশ্য হয়। তবে আগ্রার তাজমহল আর ফতেপুর সিক্রি ছুঁয়ে না ঢুকলে রাজস্থান দেখার রোমান্সের ভিতই তৈরি হয় না। রাজস্থান রাজারাজড়ার জায়গা। তাই সেখানে রাজার মতই যেতে হয়। না হলে আর রাজার মত সম্মান পাবেন কি করে? তো আমিও প্রথমবারে গিয়েছিলাম ওই প্রায় রাজার মতই। রাজত্ব ছিলনা ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সেঁটে ছিল দুই শালী। রাজা শালীবাহন, ছিলেন না একজন?
রাজস্থান লম্বা ট্যুর। অনেক ঘোরা,অনেক খাওয়া আর অনেক গপ্প। কাজ কি ওতসবে।তার চেয়ে চলুন একেবারে জাম্পকাট করে চলে যায়, যোধপুর। যোধপুরের কথা মনে পরে নিশ্চয়ই। এখানেই সার্কিট হাউসেই ফেলুদা ছিলেন না? আমরা অবশ্য উঠেছিলুম একটা হোটেলে। কোন সে হোটেল, সে নাম আর মনে নেই। তবে যোধপুর ষ্টেশনের কাছে একটা হোটেলে খাবার কথা মনে আছে। পুরো শাকাহারী। গরমাগরম রুটির উপর দরাজ হাতে দেশী ঘিউ মাখিয়ে, সবজী, আচার, অড়হর ডাল আর শেষে লস্যির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মনে হল, জীবনে আর চাওয়ার কিছুই নেই।
যোধপুরের ক্লোকরুমে মালপত্র রেখে উঠে বসলুম জয়সলমীর এক্সপ্রেসে। রিজার্ভেশন করাই ছিল প্রায় ঝাড়া হাত পা। ভোরে পৌঁছবে জয়সলমীর। অভিজ্ঞতার অভাব যে কি নিদারুণ তা বুঝলুম ট্রেন কিছু রাস্তা চলার পরেই। সব শীতবস্ত্র তো ক্লোকরুমে রেখে এসেছি। আর এদিকে ট্রেন যত মরুভূমিতে ঢুকছে ততই শীত যেন জাপটে ধরছে। শোয়া থেকে উঠেবসা, দাঁড়ানো, শেষে কামরার এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতে করতেই ভোরভোর পৌঁছে গেলুম জয়সলমীর। ট্রেন থেকেই নেমেই, সামনেই সেই সোনার কেল্লা। সেইসব দিনে বাঙালির মনে ফেলুদা, সোনার কেল্লা,লালমোহন বাবুকে নিয়ে যে রোমান্টিসিজম ছিল, তা আজকে আর বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমরা জমে গেলাম দস্তুরমতন। শীতে আর রোমান্সেও।
উটের দুধের ঘন চা সেও পেয়ে গেলাম স্টেশন চত্তরেই। তখন জয়সলমীরে এত হোটেল ছিলনা। ট্যুরিস্ট লজে জায়গাও হয়ে গেল। তখন হলিউডের এক সিনেমার শুটিং চলছিল। তাদের লোকেই গোটা লজ ভর্তি। তো হল জয়সলমীর দর্শন ইত্যাদি। সে সব সাতসতেরোতে যাচ্ছিনা। আসল চমক বা চমৎকার ফেরার পথেই। ট্রেনেই ফিরছি যোধপুর। এবার অবশ্য দিনে দিনেই। পোখরানের নাম তো সবার জানা। তখন অবশ্য এ নাম খুব পরিচিত ছিলনা। ছোট্ট স্টেশন। স্টেশনের বাইরেও যে খুব জমজমাট, তা নয়। তবে আমাদের ট্রেনের স্টপেজ ছিল এক ঘন্টা। একটু হেটে বাইরে আসতেই চোখে পরল ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান। চমচম বানাচ্ছে একজন। সাদা গুরো ক্ষীরের আস্তরণ মাখা। এক একটা প্রায় কোলবালিশের মতই। আর স্বাদ। ব্যাস পুছিয়ে মত। পোখরানের আনবিক বোমা বিস্ফোরণের বহু আগেই পোখরানের চমচমের স্বাদের বিস্ফোরণ, সে শুধু আমিই জানি, আর আজও সে স্বাদের অনুরনন আমার অনুভবের পরতে পরতে। এ তো প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগের ঘটনা। এই বছর কয়েক আগেই আবার জয়সলমীর গিয়েছিলুম। ফেরার পথে পোখরানেও থেমেছি। শুধু চমচমেরই জন্যেই। কিন্তু সেই স্বাদ আর ফিরে আসেনি। ৩০/৩৫ বছর আগে জীবনের যে স্বাদ ছিল তা আর ফিরবেই বা কি করে?
No comments:
Post a Comment