Sunday, 23 March 2025

কালীপ্রসন্ন সিংহ


 আজ চারটে বাজতেই বেড়িয়ে পড়েছি বিশেষ এক উদ্দ্যেশ্য নিয়ে। অন্যদিন হলে উদ্যেশহীন ভাবে বেড়িয়ে পরি, উদ্যেশহীন।  অবশ্যই উত্তর কলকাতায়। আসল কলকাতা, বাবু কলকাতা। সে কলকাতার সোঁদা গন্ধ হয়, পুরনো বিবর্ণ বাড়ী ঘরদুয়ার দেখে যাদের মন খারাপ হয়, যাদের ঘাড়ের উপর বেঙ্গল রেঁনেসার চরিত্ররা ক্রমাগত নিশ্বাস ফেলে, আমি সেরকম





ভাগ্যবানদের একজন। 

আজ কেন বেড়িয়ে পরেছি, কিই বা উদ্যেশ, সে সবই বলব তার একটা পটভূমিকা আছে।আমাদের একটা ছোট্ট ক্লাব আছে, নাম তার চার ইয়ারী। মানে চার বন্ধু সমাবেশ। আমি,শিশির, জয় আর নির্মাল্য মাঝেমধ্যেই আড্ডায় বসি। উদ্যেশ অবশ্যই আড্ডা মারা।তবে আড্ডা মারতে গেলেও, পান,অনুপানের সঙ্গত লাগে, না হলে আড্ডা জমে না। পান হয় যথেষ্টই, সেটা জোগায় শিশির প্রধানত, আর নির্মাল্য।  উৎকৃষ্ট স্কচ/সিঙ্গল মল্ট। সে যায় হোক, এখানে কিন্তু পান করাটাই অনুপান তূল্য। এখানে বিষম বিশাল বৌদ্ধিক  আলোচনা হয়। নাটের গুরু শিশির, তার সাথে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেয় নির্মাল্য।  জয় মাঝেমধ্যে from Auditors point of view মূল্যবান মতামত দেয়। তবে আসর জমে যায়। ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে গেলেও, কিসিকা কই পড়েশান নেহি। আজকাল এতো এপ বেড়িয়ে গেছে, ফেরার টাক্সি পেতে কয়ি পড়েশান হোতা হি নেহি।


সে যাইহোক,  গত সেশনে ঠিক হলো পুরনো কলকাতা ঘোরা হবে। নির্মাল্য কালীপ্রসন্ন শিংহের বাড়ীর কথা তুললো। পুরনো কলকাতা আমার হাতের তালুর মত চেনা। কিন্তু কালীপ্রসন্নর বাড়ীটা চিনতাম না। তাই আজ বেড়িয়ে পড়লাম ছানবিন করতে। জোঁড়াসাকো রামমন্দিরের উলটো দিকে বানারসি ঘোষ স্ট্রীটে।  খুব সহজেই পৌছনো গেল। সে বাড়ীর অতি জরাজীর্ণ অবস্থা। চারিদিকে বটবৃক্ষ জন্মে গেছে। ভেতরে কয়েকজন দখলদার আছে। ভেতরে ঢুকতে দিল,কিন্তু ছবি তুলতে দিল না। পুরো জোঁড়াসাকো অঞ্চলটাই অবাঙালী দখলে। এককালে বাঙালী সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু আজ বেদখল। বাঙালী যে আত্মবিস্মৃত জাতি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কালীপ্রসন্নর বাড়ীটা শুনেছি ফার্স্ট ক্লাস হেরিটেজ তকমা পাওয়া।  কিন্তু না বাড়ীর গায়ে আছে কোন Plaque  না কোন রক্ষণাবেক্ষণ।  কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্মন্ধে আপনারা কমবেশি সবাই জানেন। তার উদ্যোগে ও অর্থানুকুল্যে মূল সংস্কৃত থেকে মহাভারতের বাংলায় অনুবাদ করা হয়। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজী হয়েছিলেন সেই মহাভারতের সম্পাদনার ভার। কালীপ্রসন্ন সিংহ আরো এক কারণে বিখ্যাত।  তিনি লিখেছিলেন ' হুতোম পেঁচার নকশা'।  এক বিশেষ ধরণের গদ্যরীতির প্রচলন করেছিলেন।  কিন্তু মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' মাষ্টারপিসে তার বিশেষ উল্লেখ আছে। উপন্যাসে তিনি নবীনকুমার। এক বর্ণময় চরিত্র। উপন্যাসে বিবৃত তার পিতৃবন্ধু বিধুশেখর তার জন্মদাতা পিতা। কারণ তার সামাজিক পিতার সময় কেটে যেত, রাঁড়ের বাড়ীতে। যা সেই সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ওটাই ছিল বাবুকালচার,  পায়রা  ওড়ানো আর গহরজান, নিকি বাঈজীদের পেছনে লাখ লাখ টাকা উড়ানো।

কালিপ্রাসন্ন সিংহের বাড়ী দেখা হয়ে গেলো। মিশন একোমপ্লিশড। এবার বিলে মানে বিবেকানন্দের বাড়ী বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চলা, নকুড়ের দোকান পড়ল পথে, উপেক্ষা করলাম। হরিঘোষ স্ট্রীট পেরিয়ে এসে গেলাম শ এর তেলেভাজার দোকানে। মোটা মোটা ধোঁকা কিনলাম।  কাল ডালনা হবে। আপনারা কেউ ধোঁকা খেয়েছেন, সুন্দরীদের  কাছে? আমার সেই ধোঁকা খাওয়ার কোন মুহরতই তৈরী হয়নি। তাও কুন্তলা এখনও সন্দেহ করে। আরে বাবা, আগে যখন দেবদূতের মতো চেহারা ছিল, তখনই কিছু করিনি, আর এখন এক পা নিমতলায় রেখে কি প্রেম হয়? হ্যায় কোয়ি? 

যাকগে, এর ফাঁকে দেখি একদল সুন্দরী বসন্তের গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে শোভাযাত্রা করে। দেখলাম কিছুক্ষণ।  ছবিও তুলেছি, দেব এরসাথে।


আমি এখন দর্জিপাড়ায় জয়ন্তের সাথে গল্প করছি। এক কানে জয়ন্তের কথা শুনছি, টুকটাক হ্যাঁ হুঁ করছি, আর এক আঙুলে, এক মনে আপনাদের জন্যে ভাটকথা লিখছি। তার মানে আমার মন দুটো ফিল্ডে কাজ করছে একইসময়ে। এটা আমার বিশেষ গুণ। অবশ্য এটা আয়ত্ব করতে দীর্ঘ সাধনার দরকার। দুহাত এজসাথে কাজ করলে সে হয় সব্যসাচী আর আমার মন যে একসাথে দুজায়গায়, খেপ খাঁটে, আমি তাহলে কি? নিশ্চয় স্পেশাল কিছু????

No comments:

Post a Comment