Saturday, 23 November 2024

এ শ্যাম এ মস্তানি

 এ শ্যাম এ মস্তানী


আজকের সন্ধ্যেটা সত্যিই মনে রাখার মতই। আজ ছিল আমাদের সিটং যাবার প্রি-ওয়েডিং বা ওয়ার্মিং পার্টি। এই সবে সীসামারা জলদপাড়া ঘুরে এসেছি গত মাসেই। সীসামারার সবুজ বনানী, পাহাড়ি নদীর কুলুকুলু ঠান্ডা ঠান্ডা জলে অবগাহন স্নান আর নদীর পাড়ে ময়ুর ময়ুরীর  নাচ এখনও ফিকে হয়নি স্মৃতি থেকে। সীসামারার হ্যাংওভারের রেশ এখনও কাটেনি । এমনকি জলদাপাড়ার সেই গন্ডারের কাতর চাহনি এখনো বিহ্বল করে রেখেছে। 

এর মধ্যেই নতুনের আমন্ত্রণ।  এবার সিটং থেকে। মংপু ছাড়িয়ে আরো ওপরে। মংপু নিশ্চয় সবার চেনা,সবার জানা। সে যান আর নাই যান। মৈত্রিয়ী দেবীর 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ' কে না পড়েছেন বা নাম শুনেছেন।  তারও ওপরে সিটং কমলা লেবুর বাগান ঘেরা এক অপুর্ব সুন্দর পাহাড়ি উপত্যকা।  যার সৌন্দর্য নাকি বহুগুণ বাড়িয়ে রেখেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।  সেখানেই আমাদের কাটবে আগামী চারটে দিন। এবারের দল সীসামারার থেকেও আড়ে বহরে ভারী। মোট ২১ জন।  সবাই আমরা ননীচোরার দলে। ননীকে নিশ্চয়ই আলাদা করে চেনাতে হবে না। এই যে আমাদের ঘোরাফেরা সবই ননীর নিয়ন্ত্রণে।  আজকের আসর ছিল পার্ক স্টীটে Bar-B-Que. উদ্দেশ্য একটাই ওই যে বললাম ওয়ার্ম আপ মানে একটু গা ঘেষাঘেষি করে ভাইচারার ওমের উত্তাপ নেওয়া। আজকের উদ্যোক্তা ছিলেন সুব্রতদা। তারই রিফ্রেশার কোর্স হল আজ বারবিকিউ এ। যথেষ্ট পরিমাণ শান্তি বারির আয়োজন ছিল উপাচার সমেত। এর মধ্যে গৌতমের ফোন এল রাঁচি থেকে। গৌতমকে মনে নেই?  ননীর সহকর্মী আর আমার সহযাত্রী ছিল টাইগার্স নেস্টের চূড়া পর্যন্ত।ওর স্ত্রীর কথা মনে পড়ে খুব। যেমন গান গান তেমনি ট্রেকিং এ পারদর্শী।  ওনার সাহসে সাহসী হয়ে আমার মত ভীতু লোকও বাঘের পিঠে চাপতে পেড়েছিলাম শেষ পর্যন্ত।  আর অক্ষত শরীরে নেমে আসার পেছনেও তারই অসীম সাহস৷ গৌতমের ভারী অনুযোগ,আমি কথা দিয়েও কথা রাখিনি৷ অর্থাৎ এবার গৌতমের রাঁচির বাড়িতে যেতেই হবে। না এবার সত্যি সত্যিই যেতে হবে রাঁচি। যদিও মাথা এখন পর্যন্ত সাফই আছে।  ভারী ভালো মানুষ এই গৌতম আর তার স্ত্রী। এবার পুরোন কথা থাক। ফিরে চলি সেই সিটং য়েই।


সিটং এর এডভান্স পার্টি বেরিয়ে পড়ছে এই সাত তারিখেই দার্জিলিং মেলে। আমরা এবার ট্রেনের টিকিট পাইনি। তাই আমি সুব্রতদা আর সুজিত যাচ্ছি এরোফ্লোটে বাগডোগরা।  ননীরা আমাদের তুলে নেবে ওখান থেকেই। ২১ জনের দল। বুঝতেই পারছেন হবে একদম নরক গুলজার। সে খবর যথাসময়ে দেব। আজ এখানেই থাক৷ আমার আবার বড় লেখা লিখতে ইচ্ছে করে না এমনকি পড়তেও। আপনিও নিশ্চয় আমারই দলে।

Saturday, 17 August 2024

কদম কদম বাড়ায়ে যা

 


কদম কদম বাড়ায়ে যা

খুসী কে গীত গায়ে যা


আজ রোববার, ইংরেজি ১৮ই আগষ্ট, বাংলা ১লা ভাদ্র, ১৪২৬ দিবা ৬ ঘটিকা মাহেন্দ্রযোগ। এতসব সত্যিই কি লেখার দরকার? আমি শ্রীমও নই আর কোন কথামৃতও লিখতে বসিনি। নেহাৎই আমার প্রলাপ বচন। ইচ্ছে হলে শুনতেও পারেন না হলে কানে গুজুন তুলো।

আসলে এখন আমার রোজই রোববার। একই তিথি, একই নক্ষত্র আর যোগ রোজই মাহেন্দ্রযোগ। আসলে প্রতিদিনই যে ২৪ ঘন্টায় হয় সে হিসেব আগে করিনি। তখন মনে হত আরও কয়েকঘন্টা দিনের হিসেবে জুড়লে বেশ হত। একটু ফেলে ছড়িয়ে চলতে পারতুম। কিন্তু এখন ২৪ ঘন্টা মিনিট গুনে সেকেন্ড গুনে কাটাতে হয়। মোটামুটি দিনের বেশীর ভাগটাই ভরপুর টইটম্বুর করে রাখি। কিন্তু রোববারের এই দুপুরটায়  মন বড় উচাটন হয়৷ আজও তেমনই এক রোববার।  চার দেয়ালের এই বাঁধন থেকে মুক্তি চায় মন। ওই যে রবিবাবুর গানে আছে না, ' এই আকাশে মুক্তি আমার...' পাখা থাকলে উড়েও যেতাম। একবার সত্যি সত্যিই উড়েই গিয়েছিলাম।  সে অনেক অনেক দূরে। তখন আমি নিমতিতায় থাকি। বরদাচরণ মজুমদার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়। বিরাট যোগী,সাধক। আমাদের দেশ, কাঞ্চনতলায় বাড়ী।  তার প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন নিমতিতা স্কুলের হেডমাস্টার মশায় অনিল সান্যাল্। তার কাছে আমার যোগ ধ্যানের প্রথম পাঠ। তো ধ্যানেই একদিন জাস্ট উড়ে গেলাম। সে এক বিরাট অনুভূতি।  পৃথিবী,চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ছাড়িয়ে কোথায় যে যাচ্ছিলুম কি জানি। ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলুম। তারপরে অনেক চেষ্টাই করিছি, কিন্তু আর ইঞ্চি ছয়েকের বেশী উঠতে পারিনি। এটুকু শুনেই আপনার হয়ত ভাবতেই পারেন এ বেটা ঠিক টেনীদার গলি ঘুরে এসেছে আর টেনীদা ভর করেছে এই বেআক্কেলের মাথায়। 


সত্যি সত্যিই আজ মাহেন্দ্রযোগ ধরেই বেড়িয়েছি৷ বাসে ট্রামে নয় একেবারে পদব্রেজে। হাটতে আমার ভারী ভাল লাগে। আর আমার হাটার প্রিয় জায়গাও এই উত্তরে। ইচ্ছে ছিল দর্জীপাড়ার নতুনদার সাথে আড্ডা মেরে সন্ধ্যেটা কাটাব। কিন্তু হাজার ডাকাডাকিতেও তার সাড়া পেলুম না। হয়ত ভাগলপুরেই ভাগলবা হয়েছে শ্রীকান্তের খোঁজে। উত্তরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চললুম। উত্তরের গলিতে গলিতে দেবদেবীর অবস্থান। এখানে সন্ধ্যে হলেই কাঁসরঘন্টার ভারী মিষ্টি আওয়াজ। মানুষের এখনও অচলা বিশ্বাস তাদের ঠাকুর দেবতায়। এই বিশ্বাসের আড়ম্বরহীন আয়োজনে আমারও নীরব সমর্থন।  ধর্ম থাকুক সে একক বা সমবেত বিশ্বাসে। কিন্তু দাঁতমুখ খিচিয়ে যেন তেড়ে না আসে। এইখানেই আবার রামকৃষ্ণ।  যত মত তত পথ। থাকুক না সব বিশ্বাস পাশাপাশি হাতে হাত রেখে তা হলে কি ভালই না হয়। আমারও খুব পছন্দের এই প্লুরালিস্টিক সমাজ। অনেক ধর্ম, অনেক ভাষা অনেক সংস্কৃতি সংসার সমাজ আলো করে এই প্রকৃতির মত তার নানা রঙ,রুপ, গন্ধ নিয়ে থাক। যাক সে সব ভাবের কথা। আমি নিতান্তই অ-ভাবী মানুষ। এসব নিয়ে বেশী কথা বলা আমায় মানায়ও না।

যাক নতুনদাকে ধরতে না পেরে এগিয়ে চললুম, শোভাবাজার রাজবাড়ীর পানে। ইচ্ছে আজকের সন্ধ্যেটা রাজামশায় স্বপন দেব মহাশয়ের সাথেই পানালাপেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণে বেরোলেও রাজামশাইকে ফোনে পেলুম না। রাজবাড়ীর ফটক ঠেলে ঢুকে পড়তেই পারতুম। কিন্তু আমিও তো নবাব বাদশার দেশেরই লোক। এরকম বেয়াদব আচরণ কি আমার শোভা পায়? তাই চরৈবতিই। শেষে নেতাজির দোরগোড়ায় এসে থামতেই হল। পাঁচমাথার মোড়ে কালীমার দর্শন সেরে নুচি সন্দেশ খেয়ে আবার সেই সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে পুর্নমুষিক ভব।

Wednesday, 31 July 2024

দিল্লি দূর নেহি

 এবার দিল্লি এসে অব্দি বেশ টোটো করে ঘোরা হচ্ছে। দিল্লি বিরাট শহর।  তার এস্পার ওস্পার করে যাচ্ছি এবেলা ওবেলা, যদি ভেবে থাকেন টোটো করে, তাহলে আপনার বোঝার গোঁড়াতেই গলদ। টোটোর সাধ্য নেইকো এতো লম্বা দৌড় দেওয়ার। অটোও এতটা পারবে না। সে আপনি যদি ওলা/উবের নেন, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু মধ্যবিত্তের পকেটের এতো ক্ষ্যামতা নেই, যে দুবেলা ওলা/উবেরের খরচ সামাল দিতে পারবে। তাও আমি ঘুরছি, ঘুরেই চলেছি। ক্যামনে কও দেখি? আছে আছে সে উপায়ও আছে। এবার দিল্লিতে এসে উঠেছি করোলবাগে।  ওই যে দিদির কত রকমের পকল্প আছে না, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে হ্যান, দুয়ারে ত্যান। তেমনটি ঠিক নয়। এটা দুয়ার ছাড়ার প্রকল্প। করোলবাগ মেট্রো এবার আমার দিল্লির আস্তানার ঠিক দোর গোড়ায়। তাই অটো, টোটো, উবের সবের সবাইকেই দিয়েছি তালাক। পুরো মেট্রোর পিঠে চেপে এপার ওপার দিল্লি হিল্লি কিছুই বাদ দিই নিকো। আর দিল্লি রাজধানী বলে কথা তার মেট্রোও রাজকীয়।  যেমন বিস্তিত এর নেটওয়ার্ক।  তেমনি ঘড়ি ধরে মেট্রো আসছেই মিনিটে মিনিটে। তাই নো তাড়াহুড়ো।  ট্রেন যদি মিসও করেন, জানবেন তার পরের মিনিটেই ট্রেন এসে যাবে। ৩৯৩ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক, ১২ টা লাইন আর ২৮৮ টা মেট্রো স্টেশন।  ভাবা যায়? আরো বেড়েই চলেছে। দিল্লির মেট্রোর এপটাও অসাধারণ।  শুধু কোথা থেকে কোথায় যাবেন, লিখে দিন।  নিমেষে আপনাকে রুট প্লান দিয়ে দেবে। যা দেখে আমার মতো আহাম্মকও পৌঁছে যাবে তার গন্তব্যে। সে যা হোক অনেক গুণকীর্তন তো হলো। এবার অন্য প্রসঙ্গেই আসি।


যাতায়াত যত ডানা মেলেই করি। খাওয়া দাওয়া নিয়ে বেশ কষ্ট। একে তো পাঞ্জাবী ডেন। তার খাওয়া দাওয়াও তেমনই বল্লে বল্লে টাইপ। ইতনা ঘিউ, ইতনা মালাই ওয়ালা খানা যে আমার মতো পেটরোগা বাঙালীর কাছে সক্রেটিসের হেমলক পানের তুল্য। এক আধবেলার বেশী সহ্য করা মুস্কিল। আর আছে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার।  ওদের সবেতেই ইমলি গোলা।  হায়দ্রাবাদে একবার বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। তাতেও দেখি ছোট একটা বাটি ভর্তি তেঁতুল গোলা জল দিয়েছে। কি নিদারুণ পরিহাস। 


সে যাই হোক দিনে পাঞ্জাবি আর রাতে দক্ষিণীই চলছে। রাতে দক্ষিণী খাবার একটা এডভান্টেজ অবশ্য পাচ্ছি। সকালে উঠে পুরো ক্লেদমুক্ত শরীর। পুরো ফুরফুরে মন আর হাল্কাফুল্কা শরীর আর মন নিয়ে হিল্লি দিল্লি যেখানে ইচ্ছে উড়ে বেড়ান।


আর বিকেলে সামোসা আর জিলিপি আমার অলটাইম ফেভারিট তো আছেই। আমার ডায়েটিশিয়ান আমাকে পাঁচ পাতার ডুস এন্ড ডোন্টস দিয়েছে। তাতে সিঙ্গারা আর জিলিপি নৈব নৈব চ।  ডায়েটিশিয়ানকে মারো গোলী। পৃথিবীতে কে বা কবে অমর হতে পেরেছে? আর যারা জিলিপির স্বাদ নিতে অপারগ। তারা যে জীবন্মৃত।  তাদের কথা ভেবে আমার বড্ড মায়া হয়।

Thursday, 11 July 2024

ইলিশ ও সুন্দরী

 



ইলিশ ও সুন্দরী

তখন ১৯৭৯-৮০।  লেকটাউনে থাকতাম,  আমার অফিস তখন আমহার্স্ট স্ট্রীটে। স্কুটার চালিয়ে  ব্যাংকে আসতাম, গায়ে লাল সার্ট, চোখে সানগ্লাস  মানিকতলা হয়ে আমহার্স্ট স্ট্রীটে ধরে সিটি কলেজ পেরিয়ে রোজ ছিল আমার আসা যাওয়া।  ফেরার পথে মানিকতলা বাজার পরত। মানিকতলা বাজারের মাছ মানে কলকাতার সেরা মাছ। চওড়া চওড়া ইলিশ  কিনে নিয়ে যেতাম প্রায়ই। তখন ইলিশের এত আকাল ছিল না। বর্ষাকালে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা তখন ঘন ঘন রাতের মেনুতে থাকত। তো আরও অনেক কিছুর মতই সে সব দিনও আজ শুধুই অতীত, বিষন্ন অতীত।

তবে এত ভুমিকা নেহাৎ ইলিশের জন্য নয়। সে ছিল একজন। আজ হঠাৎই মনের পর্দায় ভেসে উঠল তারই জলছবি, মনের কোন গভীর গহন কোণে সে এতদিন অশোকবনে সীতার মতই বন্দী হয়ে ছিল।  সেইসময়,আমার চেহারার জৌলুশও ছিল খুব৷ মধুমেহ আসতে তখন অনেক বাকী।  সিটি কলেজের অনেক মেয়েই তখন দাঁড়িয়ে থাকত যেন আমারই প্রতীক্ষায়। এক সুন্দরীর সাথে নিত্য হত চোখাচোখি। স্কুটারের গতি হয়তো কমে আসত কিন্তু থামতে পারিনি কোনদিনও। আজ ৪০ বছর বাদে সেইরকমই এই মেয়ের সাথে দেখা। তাই তার কথা আজ চকিতে মনে পরল। এই মেয়ে, হয়তবা সেই মেয়েরই মেয়ে,যে মেয়ে এতদিন লুকিয়ে ছিল আমারই মনের গভীরে। আজ যেন সে মুক্তি পেল তার বন্দীদশা থেকে। আর আমাকেও মুক্ত করে দিয়ে গেল।

Saturday, 29 June 2024

যোধপুর টু জয়শলমীর

 ফেলুদারা পুরনো হয় না


যোধপুর টু জয়সলমীর 


তখন সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা সবে দেখেছি। একে জাতিস্মর মুকুল সঙ্গে ফেলুদা, গ্লোব ট্রটার কামু মুখার্জি, লালমোহন বাবু, সর্বোপরি সোনার কেল্লা। সে এক জমজমাট ব্যাপার।  কামু মুখার্জি আমার খুব চেনা। দাপুটে অভিনেতা তো বটেই। তবে বাস্তবেও তিনি খুব দাপুটে ছিলেন। প্রায়দিনই সন্ধ্যাবেলায় তার সঙ্গে দেখা হত।  থাকতেন  ফুলবাগানের মোড়ে। তবে টপভূজঙ্গ অবস্থায়।  বাংলায় পুরো নিবেদিত। তখন যে সব সংলাপে গমগম  করতেন, তা লেখায় অসুবিধে আছে।  আর লালমোহন বাবু মানে সন্তোষ দত্ত থাকতেন  মানিকতলায়।  ছায়া সিনেমার পাশের গলিতেই তার বাড়ী। অনেকবারই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ দুএকবার তার সঙ্গে যেচে গিয়ে কথাও বলেছি। ভারী বিনয়ী ভদ্রলোক ছিলেন। বাকী রইল তপসে। তপসে কিন্তু শেয়ার বিশেষজ্ঞ। শেয়ারের উপর অনেক বইও আছে।  তো, তার কাছে ক্লাসও করেছি কিছুদিন।  ওই শেয়ার নিয়েও। যদিও সুবিধে করতে পারিনি মোটেই। তবে এসবই  নেহাৎই পরের কথা।   আর আমার এই যাত্রা অনেক আগের,  প্রায় বছর ত্রিশেক কি তারও আগে। শুধু জয়সলমীর অবশ্য নয়। পুরো রাজস্থানই। রাজস্থান  বরাবরই আমার প্রিয় রুট, আগ্রা হয়ে ভরতপুর ছুঁয়ে জয়পুর দিয়ে ঢোকা। এর উল্টোটাও অবশ্য হয়। তবে আগ্রার তাজমহল আর ফতেপুর সিক্রি ছুঁয়ে না ঢুকলে রাজস্থান দেখার রোমান্সের ভিতই তৈরি হয় না। রাজস্থান রাজারাজড়ার জায়গা। তাই সেখানে রাজার মতই যেতে হয়। না হলে আর রাজার মত সম্মান পাবেন কি করে? তো আমিও প্রথমবারে গিয়েছিলাম ওই প্রায় রাজার মতই। রাজত্ব ছিলনা ঠিকই  কিন্তু সঙ্গে সেঁটে ছিল দুই শালী।  রাজা শালীবাহন, ছিলেন না একজন?  


রাজস্থান  লম্বা ট্যুর। অনেক ঘোরা,অনেক খাওয়া আর অনেক গপ্প। কাজ কি ওতসবে।তার চেয়ে চলুন একেবারে জাম্পকাট করে চলে যায়, যোধপুর। যোধপুরের কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই।  এখানেই সার্কিট হাউসেই ফেলুদা ছিলেন না? আমরা অবশ্য উঠেছিলুম একটা হোটেলে।  কোন সে হোটেল,  সে নাম আর মনে নেই। তবে যোধপুর ষ্টেশনের কাছে একটা হোটেলে খাবার কথা মনে আছে। পুরো শাকাহারী। গরমাগরম রুটির উপর দরাজ হাতে দেশী ঘিউ মাখিয়ে, সবজী, আচার, অড়হর ডাল আর শেষে লস্যির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মনে হল, জীবনে আর চাওয়ার কিছুই নেই।

যোধপুরের ক্লোকরুমে মালপত্র রেখে উঠে বসলুম জয়সলমীর এক্সপ্রেসে। রিজার্ভেশন করাই ছিল প্রায় ঝাড়া হাত পা। ভোরে পৌঁছবে জয়সলমীর। অভিজ্ঞতার অভাব যে কি নিদারুণ তা বুঝলুম ট্রেন কিছু রাস্তা চলার পরেই। সব শীতবস্ত্র তো ক্লোকরুমে রেখে এসেছি। আর এদিকে ট্রেন  যত মরুভূমিতে ঢুকছে ততই শীত যেন জাপটে ধরছে। শোয়া থেকে উঠেবসা, দাঁড়ানো, শেষে কামরার এ মাথা ও মাথা পায়চারি করতে করতেই ভোরভোর  পৌঁছে গেলুম জয়সলমীর।  ট্রেন থেকেই নেমেই,  সামনেই সেই সোনার কেল্লা। সেইসব দিনে বাঙালির মনে ফেলুদা, সোনার কেল্লা,লালমোহন বাবুকে নিয়ে যে রোমান্টিসিজম ছিল, তা আজকে আর বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমরা জমে গেলাম দস্তুরমতন। শীতে আর রোমান্সেও। 


 উটের দুধের ঘন চা সেও পেয়ে গেলাম স্টেশন চত্তরেই। তখন জয়সলমীরে এত হোটেল ছিলনা। ট্যুরিস্ট লজে জায়গাও হয়ে গেল। তখন হলিউডের এক সিনেমার শুটিং চলছিল।  তাদের লোকেই গোটা লজ ভর্তি। তো হল জয়সলমীর দর্শন ইত্যাদি।  সে সব সাতসতেরোতে যাচ্ছিনা। আসল চমক বা চমৎকার ফেরার পথেই। ট্রেনেই ফিরছি যোধপুর।  এবার অবশ্য দিনে দিনেই।  পোখরানের নাম তো সবার জানা। তখন অবশ্য এ নাম খুব পরিচিত ছিলনা। ছোট্ট স্টেশন।  স্টেশনের বাইরেও যে খুব জমজমাট, তা নয়। তবে আমাদের ট্রেনের স্টপেজ ছিল এক ঘন্টা।  একটু হেটে বাইরে আসতেই চোখে পরল ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান।  চমচম বানাচ্ছে একজন। সাদা গুড়ো ক্ষীরের আস্তরণ মাখা। এক একটা প্রায় কোলবালিশের মতই। আর স্বাদ। ব্যাস পুছিয়ে মত। পোখরানের  আনবিক বোমা বিস্ফোরণের বহু আগেই পোখরানের চমচমের স্বাদের বিস্ফোরণ, সে শুধু আমিই জানি, আর আজও সে স্বাদের অনুরনন আমার অনুভবের পরতে পরতে।  এ তো প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগের ঘটনা। এই বছর কয়েক আগেই আবার জয়সলমীর গিয়েছিলুম। ফেরার পথে পোখরানেও থেমেছি। শুধু  চমচমেরই জন্যেই। কিন্তু সেই স্বাদ আর ফিরে আসেনি। ৩০/৩৫ বছর আগে জীবনের যে স্বাদ ছিল তা আর ফিরবেই বা কি করে?

Wednesday, 26 June 2024

ভুবন সোম

 আজ নবমী

আজকের ছবি

ভুবন সোম


ন'দিন পেরোতে চললো। এখনো মৃনাল সেনের কোন ছবির কথাই আসেনি। তাই কি হয়? আজকের ছবি আমার বিশেষ ভালোলাগার ছবি মৃনাল সেনের, 'ভুবন সোম'!

এ ছবিও অনেক আগের দেখা। বোধহয় তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছোকরা। প্রায় ফাঁকা হলে আমি আর আমার পিসতুতো ভাই বাবলু বহরমপুরের কল্পনা সিনেমা হলে দেখেছিলুম। অনেকটাই ভুলে গিয়েছিলাম।  কিন্তু ভালো লাগাটা মনে বেশ ছাপ রেখে গিয়েছিল। তাই আজ আবার ইউ টিউবে এই ছবি দেখে নিলাম। ছোট ছবি। সাদা কালোয় ঝকঝকে ছবি,বোর হবেন না মোটেই, মুগ্ধ যে হবেন এ কথা বলতেই পারি। সেই সময়ে তিন তিনটে ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছিল এই ছবি। শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম, শ্রেষ্ঠ পরিচালক আর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আর ভুবন সোম কে জানেন? উৎপল দত্ত।  তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি সে বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। আর ছিলেন সুহাসিনী মূলে।ভারী মিষ্টি এক গুজরাটি গাঁয়ের বধুর চরিত্রে।


এ ছবি ভারতীয় চলচ্চিত্রে ন্যু ওয়েভের পথিকৃৎ। শ্যাম বেনেগাল তো তার অনেক পরে এসেছেন। যদিও ফিল্ম বোদ্ধা নয়, তবু্ও এ ছবির ট্রিটমেন্ট মুগ্ধ করেছিল।জাম্প কাট কি তা প্রথম এই ছবি দেখেই জানলাম।  ভারী মুগ্ধ করেছিল আমার মত আনপড় আদমীকেও। এ ছবির সরলতা, নিপুণ বুননী আবিষ্ট করে রাখবে যে কাউকে। এ ছবির থিম কিন্তু জীবনের একঘেয়েমি, সরলতা,সমবেদনা আর সহভাতৃত্বকে কে ঘিরেই।


মূল গল্পটা এইরকম। 

ভুবন সোম রেলের এক উচ্চপদস্থ অফিসার। সৎ, ভীষণ কড়া, কোন দুর্নীতিই তিনি বরদাস্ত করেন না।  রেলের কর্মীরা তাই তাকে নিয়ে সন্ত্রস্ত।  এই পরিচয় নিয়েই ভুবন সোমের প্রবেশ গুজরাটের কোন  এক গ্রামে পাখি শিকারের জন্যে। এখানেই তার দেখা গ্রামের বধু গৌরীর সাথে। গৌরীর সাহায্যেই তিনি পরিচিত হলেন প্রকৃতির মাঝে, পাখিদের সাথে। শহুরে জীবনের ধরাচূড়া ছেড়ে গ্রামের পোষাকে তিনি মিশে গেলেন  প্রকৃতির সাথে, পাখীদের সাথে, জীবনের সাথে। চিনতে পারলেন জীবনের সরলতাকে, বুঝতে পারলেন সমবেদনা, সহভাতৃত্বের মূল্য। ভুবন সোম পাখি শিকার করতে পারলেন কি, না, সেটা কোন প্রসঙ্গই নয়। তবে শহরে ফিরে এলেন এক অন্য ভুবন সোম। বড় সমব্যথী, মানুষের প্রতি জীবনের প্রতি।  দুর্নীতির দায়ে এক রেলের কর্মীকে তিনি দিয়ে দিলেন বেকসুর খালাস৷ জাম্পকাট করে যেন ফিরে এলেন তিনি জীবনের মূলস্রোতে।

Tuesday, 25 June 2024

চারুলতা

 কোন এক পূজোর সময় লেখা


আজ অষ্টমী

আজকের ছবি 

চারুলতা 


এবার পুজো হবে কি হবেনা,  তার ঠিক নেই আর আমি অষ্টমীর ঢাকে কাঠি দিয়ে দিলাম। এ অবশ্য আমার কৃতিত্ব নয়। এই অকাল বোধনের দায়  দায়িত্ব সবই দীপকের। আমি শুধু হুকুম তামিল করে গেছি। এর পাপ পূন্য কোন কিছুই আমি চাইনে, শুদ্ধা ভক্তি, সেও আমার নয়। ভক্তি তো unconditional surrender. আমরা মুকসুদাবাদের লোক, চিরকালের ঘাড়টেঁড়া। শির নেহারি নতশির ওই...  আর যার হয় হোক, ও আমাদের নয়। ভক্তির বদলে ভালোবাসা বরং ঢের ঢের ভালো।  তিরতিরে হাওয়ার মত ছুঁয়ে যাবে,বয়ে যাবে কিন্তু বেঁধে রাখবে না।


আজকের ছবি চারুলতা। একদিকে রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' আর তাকে নিয়ে সত্যজিতের আঁকা কবিতা সেলুলয়েডে। আমরা এ ছবি দেখেছি স্কুলে পড়তে৷ তখন বোধহয় ক্লাস টেনে লালবাগের নবাব বাহাদুর স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ধুম আড্ডা চলত। কখনও মতিঝিলে কখনো হাজারদুয়ারীর সিঁড়িতে  আর কখনো বা আমাদের স্কুলের বিরাট হোস্টেলে। আরও অজস্র কতো জায়গায়ই যে ছিল,তবে এতসব জেনে কাজ নেই আপনাদের। মূল কথা আড্ডা হত জমজমাট।নবাব ওমরাহ থেকে হরিপদ কেরাণীর ছেলে সবাই আমরা বন্ধু। বন্ধুদের মধ্যে কি কোন ওপর নীচ থাকে। বন্ধু সবাই এক একজন হীরের টুকরো। আড্ডার কিন্তু কোনদিনও ছুটি নেই। বরং ছুটির দিনে সকাল বিকেল দুবেলায়। ওই বয়সেই সিগারেট ফোঁকা শিখে নিয়েছিলাম। আমাদের প্রথম প্রেম চারমিনার। আমার বা আমাদের এই ব্যসনের গুরু ছিল, পাপ্পু নবাব। নবাব হলে কি হবে, এক নম্বরের বয়াটে ছোকরা।  শুধু সিগারেট ফোঁকাই নয় কত সব দুষ্টু দুষ্টু  ছড়াই যে শিখিয়েছিল, তা আর কহতব্য নয়।

তবে , চারুলতা দেখার পরেই কিন্তু চারমিনার হয়ে গেলো আমাদের আদরের  'চারু'! চারমিনার কে আদর করে এই নামেই ডাকতাম আমরা। এখন আর আমাদের সেই চারমিনারও নেই, নেই সেই আদরের ডাক, "আমার চারু আছে'!


এমন একটা ধ্রুপদী ছবির আলোচনায় শুধু ফক্কুড়ি করে গেলাম। আসলে এতো সব জ্ঞানগর্ভ আলোচনার রসদ মানে জ্ঞানই নেই আমার। দীপককে ট্যাগ করে দিলাম, আমি নিশ্চিত ও সেই খামতি টুকু ঠিক পূরণ  করে দেবে। দীপকে আমার ভারী বিশ্বাস।  তবে পরীক্ষার খাতায় কিছুই কি লিখতে পারব না। সাদা খাতা? কভি নেহি।


  এ ছবি সবাই দেখেছেন,

 কি? না দেখলে দেখে নিন ইউটিউবে। সুন্দর এক কবিতার মত।একাকিত্বের ছবি,ভালোবাসার ছবি। হয়ত নিরুচ্চার। শীতের নদীর মত, যার ছলছলে স্বচ্ছ জলের মতই, সব দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায়না। এ ছবি তেমনই অন্তত তাই আমার অনুভবে ধরা দেয়। ফিল্ম বোদ্ধারা কি বলবেন, তা জানি না। তবে ভারী well crafted, meticulous. এবার যখন আবার দেখলাম,মনে হল এতটা নিঁখুত হবার কি কোন প্রয়োজন ছিল? এ ছবির দুটো দৃশ্য কিন্তু ভারী মনে রাখার মত। শুরুতে মাধবীর বায়নাকুলার হাতে বাড়ীর জানালায় জানালায় ছুটে বেড়ানো, যা তার অসহায় একাকীত্বের প্রতিচ্ছবি।  আর শেষ দৃশ্য চারু আর ভূপতি এক ফ্রেমে হঠাৎ ফ্রিজ হয়ে যাওয়া।  ক্রমশ লং শট। নষ্টনীড় বোঝাতে আর কিছুর দরকারই ছিল না। এর বেশী কিছু বুঝে থাকলে আমাকে জানাবেন কিন্তু। অষ্টমীর পূজো শেষ,  এবার সন্ধি পূজার আয়োজনে লেগে পড়ি?

রিয়া

 গত কয়েকদিন ধরেই  ফেসবুক মেতেছিল ননীগোপালের দোলখেলা নিয়ে। সে যে কি রঙ্গ তামাসা হয়েছে, তা দুচোখ দিয়ে না দেখলে পেত্যয় হবে না। ফেসবুকেও তার কিছু আভাস দিয়েছি আমরা সবাই। অনেকেই দেখেছেন বুড়ো ধামড়াদের লীলাকীর্তন। 

তবে দোলের দোলন এবার শেষ হয়েছে। যে যার ঘরে গিয়েছে ফিরে। তবু মনে হলো এ সবের সামনে যারা আসেনি, পেছন থেকে এই বুড়োদের আবদার, চাহিদার জোগান যারা দিয়ে গেছে মুখে ম্লান হাসি নিয়ে, তাদেরও সামনে আসা দরকার।

প্রথমেই যার কথা মনে এলো সে রিয়া। রিয়া কিন্তু বেশ আধুনিক নাম। বড়লোকের আদুরে মেয়েরাই যে শুধু রিয়া হবে এমনতো নয়। আমাদের আজকের চরিত্র, রিয়া কিন্তু পিতৃমাতৃহীন। কোথায় না কোথায় অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে, সে কে বা জানে? রিয়া কিন্তু বাঙালী কোন মেয়ে নয়। রিয়া তামাং।  তামাং উত্তরবঙ্গের এক আদিবাসী প্রজাতির মেয়ে। যে দুদিন আমরা রেনীতে ছিলাম, আমাদের সব চাহিদার জোগান দিয়ে গিয়েছে  নিরন্তর।ভারী দু:খী মেয়ে, মুখ দেখলেই বড় মায়া জাগে। ওর সম্মন্ধে আমি এতকিছু জানতে পারতাম না যদি না ননী বলতো। রিয়া ননীর সাথে দীর্ঘ পথ হেঁটে গিয়েছিল রেলী বাজারে আমাদেরই কারুর এক জরুরী ওষুধের প্রয়োজনে। ননীর একটা বড় গুণ সবার সাথেই সহজভাবে মিশতে জানে। ওই দীর্ঘপথে ও রিয়ার ছোট্ট জীবনের বড় বড় দু:খের অংশীদার হয়ে গিয়েছিল।ননীর পিতৃহৃদয় সে দু:খের কথা শুনে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। ওই ছোট্ট বাজারে কি আর পাওয়া যায়? রিয়ার ছোট্ট দুটি হাত অজস্র চকোলেট দিয়ে সে ভরিয়ে দিয়েছিল।


এখানেই কিন্তু গল্পের শেষ নয়। ওপরে রিয়ার পাশে যাকে দেখছেন, সে রোনাল্ড। রোনাল্ড লেপচা। লেপচারাই দার্জিলিং এর আদত আদিবাসী। রোনাল্ড কি এমন করলো, যাতে রিয়ার দু:খের দিনের অবসান হলো? স্রেফ রোনাল্ড রিয়াকো ভাগাকে লে গিয়া থা। দুজনেই সাদী করেছে। কাজ করছে দুজনেই ওই রিসোর্টেই। আর উপরে যে পুঁচকেটার ছবি দেখছেন, ও জাস্টিন লেপচা। রিয়ার দেওর। রিয়ার শ্বশুরও ভারী ইয়োং আর ভালোমানুষ। আমাদের জন্যে পাহাড়ী নদীর মাছ ধরে এনেছিল। রিয়া আর জাস্টিন মিলে সে মাছও রান্না করে খাইয়েছিল এই ধেড়ে খোকাদের।  সেই রান্না ওদের ভালোবাসার গন্ধ আর ওমে ভরপুর। তার তুলনা শহরের নামী দামী রেঁস্তোরার  সাথে হতেই পারে না।  

আজ রিয়া সুখী।  ভালো বর ও ঘর পেয়েছে। রিয়ার শ্বশুরবাড়ীও রিয়াকে মেনে নিয়েছে। ওরা সবাই মিলে নিটোল এক ভালোবাসার ছবি। আপনারাও সবাই ওদের আশীর্বাদ করুন যাতে ওদের আগামী দিনের পথ প্রশস্ত হয়। হয়ত অভাব আছে, থাকবেও, তাও ওরা সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে চলুক। এর বেশী জীবনে আর কি বা, চাই?

Thursday, 20 June 2024

চলতে চলতে

 পুরনো  লেখা


চলতে চলতে


আজ কলেজ স্ট্রীট যেতে হয়েছিল একটি জরুরী কাজে।  জরুরী আবার জরুরী নয়ও।  ওই শ্রডিঙ্গারের বেড়ালের মতই অনেকটা। একটু বেরিয়ে পরার ছুতো। কিন্ত বাটার মোড়ে নেমে মনে হল এর থেকে জরুরী একটা কাজ বাকী রয়ে গেছে। দীপকবাবুর খবর নেওয়া। দীপক বাবুকে নিশ্চয় ভুলে জাননি এরমধ্যে। দীপক গুপ্ত, রামকৃষ্ণ কথামৃতের,কথাকার শ্রীম, মহেন্দ্র গুপ্তের প্রপৌত্র। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান। বহুদিন অবসর নিয়েছেন। আমার সাথে তার বিশেষ ভালবাসার/স্নেহের সম্পর্ক । কিন্তু বেশ কিছুদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।দোষ একতরফা আমারই। আজ তাই আমার জরুরী কাজ ছিল আগে তার খবর নেবার, তার সঙ্গে দেখা করার।

 লাহাদের বাড়ীগুলো পাশে রেখে এগোলাম, কথামৃত ভবনের দিকে। এই অঞ্চল আমার খুবই পরিচিত এবং প্রিয়।লাহাবাড়ী, দেবদের বাড়ী, মিত্রদের বাড়ী, দত্তদের বাড়ী এককালের বনেদীয়ানার কেষ্টবিষ্টু সব। আমাদের সাথে এদের যোগাযোগ ছিল খুবই নিবিড়।  পথে পরল ঠনঠনিয়া কালীবাড়ী। যদিও অবিশ্বাসী মানে বিশ্বাসের জোর খুজে পাইনে।  দেবদেবতা, গুরুস্থানীয়দের নিয়ে মস্করা করতে ছাড়ি না, তবুও অভ্যাস বসে একটা পেন্নামই ঠুকে দিলাম  মায়ের পায়ে।যতটা না দেবতা জ্ঞানে,তার থেকে পাশের বাড়ীর ঠাকরুন ভেবে। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ীতে ঘোষেদের অংশীদারি আছে। ঘোষবাড়ীর বউ কল্যাণী আমার বিশেষ প্রিয়পাত্রী ছিলেন এককালে।  মাকালীর প্রসাদী শাড়ী, প্রসাদ অনেক পেয়েছি হাত ভর্তি করে। আসলে ঠনঠনিয়াই তে তার ডাব চিনি দিয়ে মানত, কখনো কেশবের জন্য কখনো বা মথুরের তরে। যুক্তির জালে যতই তাদের উড়িয়ে দিই, হৃদয়ের টানে কি ভাবে যেন বাঁধা পরে যায় তাদের কাছে। তাই এই উত্তরেই আমার সব প্রশ্নের উত্তর আর সব ভালবাসা এই উত্তরকে ঘিরেই। এযে বেঙ্গল রেঁনেসার আতুড়ঘর, এর প্রতিটি ধুলিকণায় যে পবিত্র সেই সব মহাপুরুষদের নিত্য আসা যাওয়া। কে সেখানে নেই? রামমোহন, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ, কেশব। তাই এই উত্তর কলকাতার বাড়ীঘর, স্থাপত্য, রাস্তাঘাটে সবেতেই বাঙালি ঐতিহ্যের সোঁদা গন্ধ আমার প্রাণ মনকে আবিষ্ট করে রাখে।


শংকর ঘোষ লেনে ঢুকে , রঞ্জিতের সাথে দেখা হল। রঞ্জিত সিং, ব্যাবসায়ী। পানের দোকান থেকে আজ বিরাট ব্যবসার মালিক। এর পেছনে অবশ্য স্টেট ব্যাংকের একটা ভুমিকা আছে । রঞ্জিতের দোকান থেকে বেশী দূরে নয় কথামৃত ভবন। বিদ্যাসাগর কলেজ পেরিয়েই,পৌছে গেলাম কথামৃত ভবনে। চেনা বাড়ী,বহুবার এসেছি। একইরকম আছে। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠেই তার দেখা। তার চওড়া হাসি দেখেই মনে হল, আমাকে চিনতে তার একটুও সময় লাগেনি


দীপকবাবুর কথা শুনলেই বুঝবেন, ইনি কথামৃতর জীবন্ত সংস্করণ।  তিনি বলেন,আমি শুনি।  আমার আজেবাজের প্রশ্নের সন্দেহের  সস্নেহ উত্তর থাকে তার ভাঁড়ারে। তিনি মোটেই রামকৃষ্ণের চৌকিদারি বা খবরদারির মধ্যে নেই। তার এই সহজ ভাবটা আমার বেশ লাগে। আমিও কথা বলে আরাম পাই।কথায় কথায় কেটে গেল দুটি ঘন্টা। এবার রওনা দিলাম ইউনিভার্সিটির দিকে। তবে আসার আগে কথা দিতে হল, আবার আসব এবং খুব শিগ্রিই। এবার যখন যাব তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব, একলা যাবনা। পরিচয় হবে বাঙ্গালীর ইতিহাসের সঙ্গে।  ফেরার পথে এক চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠে পরলাম।ট্রামে চড়ার সাথে পুরোন কলকাতার ভারি মিলমিশ। আমার মেজাজের সাথে বেশ টুংটাং করে হেলেদুলে চলে। অযথা এত তাড়াহুড়োর কিই বা দরকার?  চলুক না এইভাবেই।

Saturday, 15 June 2024

 



কোন এক ঝকঝকে রোববারের কথা। আজ বন্দীদশায় সেইসব স্মৃতিই প্রাণের আনন্দ, বেঁচে থাকার রসদ।


কদম কদম বাড়ায়ে যা

খুসী সে গীত গায়ে যা


আজ রোববার, ইংরেজি ১৮ই আগষ্ট, বাংলা ১লা ভাদ্র, ১৪২৬ দিবা ৬ ঘটিকা মাহেন্দ্রযোগ। এতসব সত্যিই কি লেখার দরকার? আমি শ্রীমও নই আর কোন কথামৃতও লিখতে বসিনি। নেহাৎই আমার প্রলাপ বচন। ইচ্ছে হলে শুনতেও পারেন,না হলে কানে গুজুন তুলো।

আসলে এখন আমার রোজই রোববার। একই তিথি, একই নক্ষত্র আর যোগ? রোজই মাহেন্দ্রযোগ। আসলে প্রতিদিনই যে ২৪ ঘন্টায় হয় সে হিসেব আগে করিনি। তখন মনে হত আরও কয়েকঘন্টা দিনের হিসেবে জুড়লে বেশ হত। একটু ফেলে ছড়িয়ে চলতে পারতুম। কিন্তু এখন ২৪ ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড গুনে কাটাতে হয়। মোটামুটি দিনের বেশীর ভাগটাই ভরপুর টইটম্বুর করে রাখি। কিন্তু রোববারের এই দুপুরটায়  মন বড় উচাটন হয়৷ আজও তেমনই এক রোববার।  চার দেয়ালের এই বাঁধন থেকে মুক্তি চায় মন। ওই যে রবিবাবুর গানে আছে না, ' এই আকাশে মুক্তি আমার...' পাখা থাকলে উড়েও যেতাম। একবার সত্যি সত্যিই উড়েই গিয়েছিলাম।  সে অনেক অনেক দূরে। তখন আমি নিমতিতায় থাকি। বরদাচরণ মজুমদার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়। বিরাট যোগী,সাধক। আমাদের দেশ, কাঞ্চনতলায় বাড়ী।  তার প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন নিমতিতা স্কুলের হেডমাস্টার মশায় অনিল সান্যাল্। তার কাছে আমার যোগ ধ্যানের প্রথম পাঠ। তো ধ্যানেই একদিন জাস্ট উড়ে গেলাম। উড়ে গেলাম মানে জাস্ট টেক অফ করলাম, প্লেনের মতো নয়, রকেটের গতিতে। সে এক বিরাট অনুভূতি।  পৃথিবী,চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ছাড়িয়ে কোথায় যে যাচ্ছিলুম কি জানি। মোক্ষলাভ প্রায় হয়েই যাচ্ছিল।   চারিদিকে এতো মুমুক্ষু দেখছি, সবাই মোক্ষের জন্যে কেমন আঁকুপাঁকু করে। কাজ নেই আমার এমন মোক্ষের, এই মাটির পৃথিবীই আমার ভালো। আপনার ভালো হন, মন্দ হন, নেশাভাং  যাই করুন, আপনাদের সঙ্গই আমার সৎসঙ্গ। আর এ ব্যাপারে আমার গুরু সেই রবিবাবুই, 'মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন পরে, বাঁধা সবার কাছে।" তাই মাঝ রাস্তায় ব্রেক কষে পিছিয়েই ফিরে এলুম, এই আপনাদেরই কাছে। এই আকাশেই আমার মুক্তি, মুক্তি আমার ঘাসে ঘাসে, ধূলায় ধুলায়।  যথারীতি, সেই মুমুক্ষুই থেকে গেলাম। বড্ড শক্ত বাংলা হয়ে যাচ্ছে। মুমুক্ষু মানে মুক্তি পিয়াসী। তাই তো মাঝেমাঝেই বেড়িয়ে পড়ি পথে পথে, ধুলায় ধুলায়। উত্তরের ঠাকুর দেবতা নিয়ে একটা পদ্যও লিখে ফেলেছি, পড়ে বলুন তো কেমন হয়েছে:


দর্জি পাড়ার রকে

পায়ে পায়ে ঘুরি, উত্তরের সব গলি

পাড়ায় পাড়ায় রকের আড্ডা, হরেক কিসিম বুলি,

বাচ্চা,বুড়ো,যুবা - সবার আসন পাকা,

মাফ কারো নেই,সবার টিকি এইখানেতেই বাঁধা,

ওবামা বা পুতিন, হোক না ইয়েলৎসিন,

সমঝে চলেন সবাই এদের, রকের বিচার পাকা ।


উত্তরের এই বাঁকে, পুরনো সব স্মৃতির ঝাঁপি আজও খুলে ডাকে,

শঙ্খ, ঘন্টা, কাঁসর ধ্বনির মাঝে, পুরনো সব দেবালয়ে,

দেবতারা আজও ওঠেন জেগে, 

দেখতে যদি চাও, দেখতে তাদের পাবে আজও,

যদি ঠিক সময়ে যাও,

সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা মারেন সবে, দরজী পাড়ার রকে।


  সে যাই হোক তারপরেও অনেক চেষ্টাই করিছি, কিন্তু আর ইঞ্চি ছয়েকের বেশী উঠতে পারিনি। এটুকু শুনেই আপনারা হয়ত ভাবতেই পারেন,এ বেটা ঠিক টেনীদার গলি ঘুরে এসেছে আর টেনীদা ভর করেছে এই বেআক্কেলের মাথায়। 


সত্যি সত্যিই আজ মাহেন্দ্রযোগ ধরেই বেড়িয়েছি৷ বাসে ট্রামে নয় একেবারে পদব্রেজে। হাঁটতে আমার ভারী ভাল লাগে। আর আমার হাঁটার প্রিয় জায়গাও এই উত্তরে। ইচ্ছে ছিল দর্জীপাড়ার নতুনদার সাথে আড্ডা মেরে সন্ধ্যেটা কাটাব। কিন্তু হাজার ডাকাডাকিতেও তার সাড়া পেলুম না। হয়ত ভাগলপুরেই ভাগলবা হয়েছে শ্রীকান্তের খোঁজে। উত্তরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে চললুম। উত্তরের গলিতে গলিতে দেবদেবীর অবস্থান। এখানে সন্ধ্যে হলেই কাঁসরঘন্টার ভারী মিষ্টি আওয়াজ। মানুষের এখনও অচলা বিশ্বাস তাদের ঠাকুর দেবতায়। এই বিশ্বাসের আড়ম্বরহীন আয়োজনে আমারও নীরব সমর্থন।  ধর্ম থাকুক সে একক বা সমবেত বিশ্বাসে। কিন্তু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে যেন তেড়ে না আসে। এইখানেই আবার রামকৃষ্ণ।  যত মত তত পথ। থাকুক না সব বিশ্বাস পাশাপাশি হাতে হাত রেখে তা হলে কি ভালই না হয়। আমারও খুব পছন্দের এই প্লুরালিস্টিক সমাজ। অনেক ধর্ম, অনেক ভাষা অনেক সংস্কৃতি সংসার সমাজ আলো করে এই প্রকৃতির মত তার নানা রঙ,রুপ, গন্ধ নিয়ে থাক। যাক সে সব ভাবের কথা। আমি নিতান্তই অ-ভাবী মানুষ। এসব নিয়ে বেশী কথা বলা আমায় মানায়ও না।

যাক নতুনদাকে ধরতে না পেরে এগিয়ে চললুম, শোভাবাজার রাজবাড়ীর পানে। ইচ্ছে আজকের সন্ধ্যেটা রাজামশায় স্বপন দেব মহাশয়ের সাথেই পানালাপেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণে বেরোলেও রাজামশাইকে ফোনে পেলুম না। রাজবাড়ীর ফটক ঠেলে ঢুকে পড়তেই পারতুম। কিন্তু আমিও তো নবাব বাদশার দেশেরই লোক। এরকম বেয়াদব আচরণ কি আমার শোভা পায়? তাই চরৈবতিই। শেষে নেতাজির দোরগোড়ায় এসে থামতেই হল। পাঁচমাথার মোড়ে কালীমার দর্শন সেরে আদি হরিদাস মোদকের বিখ্যাত দোকানে নুচি সন্দেশ খেয়ে আবার সেই সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে। পুর্নমুষিক ভব।

 No one writes to the colonel


আজ সেই অর্থে, সকাল থেকে আমার করার কিছুই ছিলনা। রোজকার আসন, প্রাণায়াম আর ধ্যানে কেটে যায় ঘন্টা দুয়েক। তারপর,  আছে তো কিছু নিশ্চয়। না হলে বিরস দিন বিরল কাজ কি করে কাটবে। ছোট্ট একটা কাজ থাকে, সেটাতেও মন সংযোগ আর মাথা খাটানোর বেশ একটা ব্যাপার থাকে। সেটাতে আপাতত বিরতি চলছে। অবশ্য অল্প কয়েকদিনের জন্যেই।সেটা এসে গেলে আর বোর হবার মতো কোন ব্যাপার থাকবে না। নাতি পুতিরা স্কুলে। ওদের এখন ইউনিট টেস্ট চলছে, তাই নিয়ে ওরাও মহাব্যস্ত। কুন্তলাও গেছে মেদিনিপুরে। উত্যক্ত করার কেউ নেই। যারা একটু ভক্ত টাইপের বা ভয় পান, ভগবান, ভূতে বা বউয়ে, তারা অবশ্যই ওফেন্স নিতে পারেন, আমার উত্যক্ত কথার প্রয়োগে। আচ্ছা বলুন তো, জীবনের এই এতটা পথ হেঁটে এসে বউকে যদি উৎপাত না ভাবি, তাহলে কি ভাবব? আমার পাড়ার এক বন্ধু, নামটা বলেই ফেলি গৌতম,বউয়ের ভয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বসল। গৌতমকে তিন মাসের রিলিফ দিয়ে, দিল্লিতে কাটিয়ে এলেন তিনি, তিন তিনটি মাস। এখন তিনি এসে গেছেন। আর গৌতমের এখন ইরেগুলার হার্টবিট আর হাই ফিভার চলছে। আমি অবশ্য সে গোত্রের নয়। জানেন তো আমি মূর্শিদাবাদী, নবাবের দেশের লোক। ' শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির'। যাকগে ওসব কথা, তার থেকে বরং গল্প করি বা কিছু ইন্টেলেকচুয়াল আলোচনাই চলুক না।


আমরা তখন লালবাগে। ক্লাস নাইন? মনে একটা প্রেম প্রেম ভাব জাগছে।যাকে দেখি তারই প্রেমে পড়ি। এরকম একটা টালমাটাল চলছে। সে সময়ই ক্যাচ কট কট। প্রেম নয়। বিপ্লব। পড়লাম তুষারের খপ্পরে। নাম লেখালাম ছাত্র ফেডারেশনে সেই স্কুল বেলাতেই। তুষারের বাড়ীতেই শনিবার মিটিং হতো। জনগান্ত্রিক বিপ্লব, পেটী বুর্জোয়া,  দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ ইত্যাদি।  এছাড়াও আমাদের একটা জমজমাট আড্ডা বসতো, হাজারদুয়ারীর মাঠে। সেটা অবশ্যই বেশ কসমোপলিটান আসর। তাতে যেমন থাকতো, জামা নবাব, পাপ্পু নবাব, অপু, পন্ডিত, মীজানুর, রবি, সোনা, নিশিথ এরা। সেসব আলোচনা মূলতো সাহিত্যকেন্দ্রিক। আমাদের সাহিত্যমুখী করে তোলার পেছনে লালবাগের 'বান্ধব সমিতি'র প্রচুর অবদান ছিলো। অফুরন্ত বইয়ের জোগান দিয়ে গেছে এই লাইব্রেরি।  সে সময়ের হট ক্রেজ ছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলি।আমাদের বিকেলের আসরে সে সব ঘুরে ঘুরেই আসতো।


এসব তো সব আগের জন্মের কথা।খুব প্রিয়, খুব কাছের, কিন্তু তাদের আজ না যায় ধরা না যায় ছোঁয়া। সব স্মৃতির জগতেই থেকে গেছে, ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। আর জানেনই তো আমি একটু স্মৃতিকাতর মানুষ।  পুরনো দিন আমাকে হন্ট করে খুব। পুরনো দিন অনেকটাই পরাবাস্তবের মতোই। ম্যাজিক রিয়েলিজম যারে কয় পরিষ্কার ভাষায়।


আজকেই সেই ম্যাজিক রিয়েলিজমের গপ্প বসানোর তাল খুঁজছিলাম এতক্ষণ।  বাজে কথায়, ফেসবুকের বেশ কয়েকটা পাতা নিশ্চয় নষ্ট করে ফেলেছি। এখন আর কি? শর্টকার্টে সারি বরং। আমার সংগ্রহে প্রচুর বই আছে।  বইকেনা আমার একটা বদভ্যাসও বলতে পারেন।তবে সব বইও যে পড়ে ফেলেছি, এমন দাবী করব না মোটেই। তবে বেশকিছুই পড়েছি।


আমার যা মানসিক গঠন, তাতে ওই ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাপারটা বেশ যায় বাস্তবের জমির উপর দাঁড়িয়ে কল্পজগত তৈরী করা। ব্যাপারটা এককথায় এমনই। আর সেটাই আমার প্যাসটাইম। এবার বলুন তো, ম্যাজিক রিয়েলিজমের সেরা লেখক কে, অবশ্যই গাব্রিয়েল গ্রাসিয়া মার্কুয়েজ। যার ডাক নাম ছিল গাব্বো।কলম্বিয়ান লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক আরো কতো কি। জীবনের বেশীরভাগটাই কাটিয়েছেন মেক্সিকো আর ইউরোপের নানা দেশে। নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। তার অসামান্য সাহিত্যকীর্তির জন্যে। তার লেখা কতগুলো বউ, ' হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড', 'লাভ এট দি টাইম অফ কলেরা', ল্যবিরিন্থ, নো ওয়ান রাইটস টু কলোনেল' 'স্ক্যান্ডাল অফ দি সেঞ্চুরী' ইত্যাদি ইত্যাদি।  ওনার বহু বইই আমার সংগ্রহে আছে। আজ কোন কাজ নেই, তাই ডিম্ভাত ( মুরগীর নয় হাঁসের) খেয়ে বসে পড়েছি, কলোনেল কে নিয়ে।


ছোট্ট বই। চরিত্রও কয়েকজন। কলোনেল, তার অসুস্থা স্ত্রী, মৃত পুত্র, শহরের এক খ্যাতনামা গায়কের ফিউনেরাল, একটা লড়াইয়ের মোরগ,এক দয়ালু ডাক্তার যিনি কলোনেল আর তার স্ত্রীকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেন। একটা ষ্টীমার আর পোস্টম্যান।  প্রতি শুক্রবার জাহাজ আসে আর জাহাজে আসে ডাক।কলোনেল' জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে থাকেন মেলের প্রতীক্ষায়,  যে ডাকে তার প্রতিশ্রুত পেনশনের চেক আসবে।দীর্ঘ ১৫ বছর প্রতীক্ষার পরেও কলোনেলের সে চিঠি আসে না। পোস্টম্যান ঘোষণা করেন No one writes to Colonel.

সংক্ষেপে এটাই সারাংশ।  এক অসামান্য  না ছোটগল্প না উপন্যাস। সুযোগ পেলে বইটা পড়ে নেবেন একবার।

Wednesday, 5 June 2024

আম দরবার

 বোধিলাভ ও ডায়াবেটিস 


এবার গেল গেল, নেই নেই করেও কিন্তু আমকে ঠেকানো যায় নি। লিচু,আম, জামে বাজার ভর্তি শুধু নয় জমজমাট।  যেদিক পানেই তাকাও এর সুরত আর খুশবু ঠিক চোখ টেনে নেবে। আম অনেকটা সুন্দরী নারীর মত। যতই চোখ ঘুরিয়ে থাক আড়চোখে একবার তাকাবে না, এমন বিশ্বামিত্র তুমি নও। গাড্ডায় ঠিক পড়বে একদিন।  মেনকা, অপ্সরাদের মত রুপবতী, রসবতীরা তোমার অপেক্ষায় আছে। শুধু ঝোলায় ভরার অপেক্ষায়। 


আর আমার সাথে আমের প্রেম সে তো কোন শৈশব আর কৈশোর থেকেই।  আম, লিচুর মরসুমে আমাদের আর  অন্য কিছুর প্রয়োজন হত না। মুর্শিদাবাদের নবাবের বাগানের আম খেয়ে কৈশোর কেটেছে। সে বড় খুশবুদার, দিলদার সময় ছিল। কৈশোরের প্রেমে অভিশাপ থাকে।  থাকে হয়ত। না হলে এবার আমি এক চিলতে আমেরও সঙ্গ করিনি। যদিও আমার আসা যাওয়ার পথে শুধু আম আর আম। সুকিয়ায়, রাজাবাজার, কলেজস্টীট বাজার, ফুলবাগান সব আমের গন্ধে মাতোয়ারা।  তবে আম, লিচু কেনায় আমার ছেদ ঘটেনি একটুও। আমার নাতি, নাতনিও ভারী ভক্ত আমের। তাই আম আমি অবিরাম যোগান দিয়েই চলেছি। এতেই ভারী তৃপ্তি। আপনারাও খান। হাপুস,হুপুস করে খান। যত চান তত খান,কিছু হবে না যদিনা আপনার নিজের মিষ্টি অধিক না হয়ে থাকে। হলে কিন্তু কন্ট্রোল কন্ট্রোল।  কোন রসেই গলবেন না। 


আম নিয়ে আমার এবারের সংযমে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। এত ত্যাগ,তিতিক্ষা, সংযম, এ তো অসামান্য। এখন যদি কোন বটবৃক্ষের তলে দুচোখ মুদে বসে পরি, তবে আমার বোধিলাভ অনিবার্য। ভাবছি বসেই পরি, এই রাম  আর কালীর দ্বন্দ্ব  নিয়ে রাজ্যজুড়ে যে অশান্তির ঘনঘটা তাতে নতুন বুদ্ধের ভারী প্রয়োজন। আপনাদের সবার নেমন্তন্ন রইল। আমের মরশুম শেষ হলে দলে দলে চলে আসবেন, আমার দরবারে। একটাই শুধু মন্ত্র জপবেন, " বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি....আমিই নতুন বুদ্ধ।

Sunday, 2 June 2024

দালমা না দলমা

 দালমায় কিছুক্ষণ


আজ গিয়েছিলাম দালমা। কি মনে হচ্ছে? হাতীদের সাথে গল্পগুজব করতে। মোটেই নয়। এতো সাহস আমার কোনদিন ছিলনা আর হবেওনা কোনদিন। আর আমিও কোন প্রকৃতেশ বড়ুয়া নয়, যে হাতীদের ভালোবেসে চিরজীবন জঙ্গলেই কাটিয়ে দেব। শুনেছি, তিনি নাকি হাতীদের সাথে কানে কানে কথাও বলতেন। পাগল আর কি। ও কম্ম কি আমার পোষায় না সাজে।  তা ছাড়া হাতীরা তো প্রায়ই আসে ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের জঙ্গলে। সেখানে যাওয়া যেতেই পারে, যদি ইচ্ছে হয়। এই কয়েকমাস আগেই তো গিয়েছিলাম গুড়গুড়িপাল জঙ্গলে ননীর সাথে, হাতী কে সাথী করার ইচ্ছে নিয়ে। কিন্তু হাতী কথা রাখে নি। আসলে,কেউ কথা রাখে না। বলেই তো গেছেন সুনীল তার সেই মন কেমন করা কবিতায়।


তাছাড়া আমি এখন আছি পুরীতে।  এখান থেকে দলমা অনেক দূর। কাছাকাছি বরং পুরীতেই খুঁজে দেখা যাক। নিশ্চয় পেয়ে যাবো। লিপুকেই বরং পাত্তা নিতে বলি। লিপু আমাদের হলিডে হোমের এক হোনহার লেড়কা। ও সব জানে। কোথায় সেই দালমা? 

খোঁজ পাওয়াও গেল। কাছেই একদম হাঁটা দূরত্বে। টুকটুকে গেলে মাত্র ৫০। কিমিতে নয় টাকায়।


বেড়িয়ে পড়লাম দালমার উদ্যেশে।  হেঁটে নয়, টুকটুকেই টুকটুক করে। আর পৌঁছেও গেলাম অল্প সময়েই। এবার বুঝলেন তো দালমার রহস্য। না? তাহলে আরো খুলে বলতে হবে। অগত্যা, কি আর করা।


'দালমা' একটা ওড়িয়া খাবারের রেঁস্তোরা বলুন হোটেল বলুন, তাইই।

'দালমা' উড়িষ্যার এক বিখ্যাত ডেলিকেসি। কি বলুন তো?  ডাল আর তার সাথে প্রচুর সবজী দিয়ে একটা চমৎকার প্রিপারেশন। দারুণ স্বাদ। আমার ঠাকুমার নিত্য রান্নায় এ পদ থাকতোই। সে বুড়ীর রান্নায় এতো স্বাদ ছিল যে আমরা সব ভাই বোনেরা হত্যে দিয়ে বসে থাকতাম তার রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। ভেতরে ঢোকা ছিলো বারণ। রান্না শেষে, বুড়ী এক এক দলা  আলগোছে ফেলে দিতো আমাদের বাড়ানো হাতে। আর তার যে কি স্বাদ, সে বলে বোঝানই যাবে না।


পুরীতে যতবারই আসি, ততবারই খাওয়া সারি ভজহরি মান্না, কস্তুরী, ষোল আনা বাঙালী এইসব জায়গাতেই। বাঙালী খাবারের ছকের বাইরে যাইনি খুব বড় একটা। তবে আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছি একটু একটু করে। এর আগে চ্যাঙ ওয়াকে ঢুকিয়ে নিয়েছি, আমাদের পুরীর রুটিনে।


এবার নতুন এন্ট্রি 'দালমা' র। বেশ হোটেল। চমৎকার রান্না। কলকাতার লোকেদের বেশ পরিচয় আছে, ওড়িয়া ঠাকুরের রান্নার সাথে। আমাদের বাড়ীর কাজেও আসে একজন। নাম গোকুল, কিন্তু ইয়ার্কি করে সবাই ডাকে হোকুল বলে। এ ভারী অন্যায়। তবে গোকুলের হাসিমুখ ব্যাজার হয় না মোটেই এইসব ঠাট্টা তামাসায়। 

 

বড্ড আজেবাজে কথা লিখে ফেলছি। সময় নষ্ট করছি আপনাদের। আসলে বাইরে এখন বেশ রোদ। বেড়োতে দেরী।  তাই নিজের বোরনেস কাটাতে আপনাদের বোর করি বরং কিছুক্ষণ। আমার টার্গেট অডিয়েন্স তো সেই সব কাজকর্ম শিকেয় তোলা পেনশনাররাই।এটা একরকম সাহায্যই করবে তাদের, বিষে বিষক্ষয়ের মতো।


এবার ডালমায় কি খেয়েছি বলি। যদি কলকাতার উড়িয়া ঠাকুরদের রান্না খাবারের দিয়ে বিচার করেন, তাহলে ঠকে যাবেন বিলক্ষণ।  খাঁটি ওড়িয়া খাবার স্বাদে গন্ধে কি বলবো? It's differert, Boss. Really different. আমরা অবশ্য ওদের বিখ্যাত পাঁখাল খাই নি। পাঁখাল হলো আমাদের পান্তাভাত। দেখলাম ওখানে অনেকেই পাঁখাল খাচ্ছে। সঙ্গে অনেকরকম সবজী, মৌরলার ঝাল ইত্যাদি।  আমরা একটু সেফই খেললাম। প্রথমবার তো।তবে সুগন্ধী চালের ভাতের সাথে অবশ্যই ছিলো দালমা, ওটাই সিগনেচার আইটেম। তার সাথে শাক আরো সব সাত সতোরো অনেক কিছু । টক টক, মিঠে মিঠে, বেশ স্বাদ।  আর আ লা কার্ত মেনু থেকে মাছ আর মাংস। পরিশেষে অবশ্যই পরমান্ন, ওড়িয়া মেনুর একটা বৈশিষ্ট্য।  কেমন খেলাম? বেশ খেলাম, পরিতৃপ্তি করে খেয়ে ফেরলাম দুজনে, আমি আর কুন্তলা।  কুন্তলা কে? এতোবছর পরে আবার বলতে হবে। ওই আর কি,  কমলি নেহি ছোঁড়তা। 😁


তাহলে ওই কথাই রইলো।  আপনাদের পুরীর মেনুতে  নতুন সংযোজন হোক এবার থেকে লী রোডের  ' চ্যাং ওয়ার' পরে ভি আই পি রোডের 'দালমা'! 

Saturday, 11 May 2024

মামা ভাগ্নে কথা

 মামা ভাগ্নে


'নরানাং মাতুলক্রম' 

কথাটা শোনা শোনা লাগছে না? আরো আছে, 'বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা' 'মিষ্টান্ন মিতরে জনা'। সব শাস্ত্রবচন। আমি অতো শাস্তর বিশারদ নই। তবে কানে আসে। তাই দু'একটা কথা বলেও ফেলি। 

প্রথমেই বলে ফেলি, আমি মোটেই ততোটা বুড়ো নই, যতটা আমাকে দেখায়, তার থেকে মনে প্রাণে আমি ঢের ঢের নবীন। আর চলনে বলনেও প্রবীণ বা বুজর্গ এর ছাপ ততটা পরেনি যতটা পড়া উচিত ছিল। এর জন্যে ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট যদি কাউকেও দিতে হয়, সে সব আমার যোগাসনের  গুরুমশাইদেরই প্রাপ্য। আর ভার্যা মোটেই আর তরুণী নন। বরং যেদিন ধরণী তরুণী ছিল গোছের একটা ব্যাপার। এ ব্যাপারে বেশী কথা না বলাই নিরাপদ। 


সে সব কথা যাক। কথা হচ্ছিল মামা আর ভাগ্নের বিষয়ে।  ভাগ্নেরা মামার ছাঁচেই নাকি অনেকটা ঢালা। এ কথা কি সত্যি? ভাগ্নে যদি আপনার থাকে মিলিয়ে দেখুন তো একবার।  হয়তো আপনার বেলায় মিললেও মিলতে পারে।আমার তো বিন্দুমাত্র মেলেনি। শরসে পাওতক। আমাকে তো চেনেন। আমার চরিত্রও জানেন। অবশ্যি নিজের চরিত্তির নিয়ে ওতো ঢাঁক পেটাব না। কবে কোথায় কি বেড়িয়ে পড়ে, কে জানে। থাক বরং।  অতটা গব্ব না করাই ভালো।  

তবে মোটের উপর মানে মোটামুটি আরকি,আমি নির্ঝঞ্ঝাট টাইপের লোক। কোনকিছুতেই গা লাগাই না। ওই 'হচ্ছে হোক' জাতের মানুষ। কিছুতেই হেলদোল নেই। স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলা, এই হচ্ছে আমার কাজ। হাঁত পা ছুড়ে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা আমার বিলকুল নাপসন্দ। ওই স্রোতে গা লাগিয়েই তো বিপদে পড়েছিলাম। একবার নয় দুবার। জানমালের সলিল সমাধি আর কি। জঙ্গীপুরের ভরা গঙ্গা সাঁতার দিয়ে পার হতে গিয়ে একেবারে ভেসে গিয়েছিলাম।  ভাগ্যিস সতু ছিল। তাই চুলের মুঠি ধরে আর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পাড়ে টেনে এনেছিল। সতু ছিল বলেই আজও আমি রয়ে গেছি। আর আপনাদের আমার বকবকানি শুনতে হচ্ছে। সব ওই সতুর দোষ।  আমার কোন দায়ও নেই, দায়িত্বও নেই। যত দোষ ওই সতু ঘোষ। মাঝেমধ্যে সতুর কথা মনে পড়ে অবশ্য । হাজার হোক আমার জীবনদাতা।  কি জানি এখন কোথায় আছে বা নেই? তবে সতুরা সতুই থাকে সারাজীবন।  বিপদ দেখলেই ঝাপিয়ে পড়ে কোনকিছুর পরোয়া না করেই।

ভাগ্নের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই এসে যাচ্ছে। আসলে ওর জীবনের অনেকটা জুড়েই আমি জড়িয়ে আছি। ঠিক প্রত্যক্ষ ভাবে নয়, পরোক্ষ হলেও খুব নিবিড় ভাবে। ওর জন্ম আমাদের বাড়ীতে লালবাগেরই হাসপাতালে।  সেখানে দিদির রাতের খাবার দিতে গিয়ে খরিস সাপের সাথে মুখোমুখি মুলাকাত । ছোবল তুলে চোখে চোখ দিয়ে কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটেনবাবের ইয়ারদোস্ত জেনে, ছোবলটা আর দেয়নি। নবাবের দেশের সাপ তো, তাদের মর্জিমেজাজই আলাদা জাতের। সেই সাপটার কথাও আজকাল আমার মনে পড়ে। সতুর মতো সেও আমার জীবনদাতা। না হলে সেদিনও এক ছোবলেই ফুঁ হয়ে যেতাম। 

ভাগ্নের জন্ম হলো। ভাগ্নের পড়াশোনার এক অধ্যায়ও কেটেছে আমাদের কলকাতার বাড়ীতেই। ওর সেলে চাকরিরও এক অধ্যায়ের সাথে আমি জড়িয়ে আছি। আর ওর বিয়ে সেও আমার নিয়ে আসা সম্মন্ধ দিয়েই।


এইভাবে ভাগ্নের জীবনের সাথে পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা স্বত্বেও ওর সাথে আমার বেজায় অমিল। আমার মতো বেহিসেবী, বেআক্কেলী নয়। ভীষণ হিতাহিত জ্ঞান, ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন, হিসেবী পদক্ষেপ আজ ওকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের চূড়ায়। এতদিন সেল আর এনটিপিসিতে কাজ করে ও আজ ডিভিসির ডিরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছে। আজ যাচ্ছি ওরই সানি পার্কের বাসায়। ডিনারের নেমন্তন্ন। 

জীবনের সব সাফল্যই আজ ওর করায়ত্ত।  কিন্তু বেচারী না জানলো বিড়ি ফোঁকার আনন্দ, না বুঝল এই আপ্তবাক্য  যে ' সাগর সে গেহরা যাম'।  না পেল মামার মতো স্রোতে ভেসে যাবার আনন্দ। আপাদমস্তক ভালো ছেলেই রয়ে গেল সারাজীবন। আসলে ওর জীবনে সতুর মতো বন্ধুরা আসেনি। আজ যদি আবার জীবনে আমার কিছু বেছে নেবার সুযোগ আসে, তবে আবার স্রোতে ভেসে যেতেই চাইব। চাইব সতুর মতো বন্ধুদেরই। রামকৃষ্ণদেবের মতই বলব, এই নাও মা তোমার পাপ, এই নাও তোমার পূণ্য আমায় আবার মহাকালের স্রোতে ভাসিয়ে দাও মা। এই নাও মা তোমার ভক্তি এই নাও তোমার অভক্তি , আমায় সতুর মতো বন্ধু আবার দিও মা।

Sunday, 5 May 2024

দীপক রাগ

 আমার ব্যাঙ্কওয়ালা বন্ধু, ভাই, বেরাদর দীপককে নিয়ে লেখা। আজকাল আর সেরকম যোগাযোগ নেই দীপকের সাথে। আসলে দীপক আলোর গতিতে এগিয়ে চলেছে, তার সাথে তালে তাল রাখা কার্যত না মুনকিন। পুরনো দিনের কথা স্মরণ করেই দীপককে সম্মান জানায় পুরনো লেখা দিয়েই।


আজ দীপকের সাথে বহুদিন পরে দেখা হল।



বোধহয় বছর পেরিয়ে গেছে। সেই রামধুরার পরে এই প্রথম।  আজ আমরা তিনমূর্তি ভাই বলরাম আর অগতির গতি,  দীনবন্ধু সুজিত গিয়েছিলাম দীপক সন্দর্শনে। দীপক যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে। সেইরকম গমগমে,ঝকঝকে প্রত্যয়ে অটল দীপক। বরঞ্চ আরও প্রত্যয়ী। সাধে কি আর ও প্রত্যয়ের প্রাণপুরুষ।  হাজারো লোক ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে আর থাকে ওর লেখার অপেক্ষায় ,  চায় ওর চলার পথের সঙ্গী হতে।  ভারী ভাল লাগল দীপককে দেখে, এ দীপক, দীপক রাগেও জ্বলল না, মেঘমল্লারেও ঝরে পরল না বরং দরবারি কানাড়ায় বেজে উঠল গমগম করে। তাতে বেজে উঠল আত্মপ্রত্যয় আর আগামীর আশ্বাস । আপনারা আশ্বস্ত থাকুন দীপক ভালো আছে, খুব ভাল আছে, নব আনন্দে আবার সে ফিরে আসছে আপনাদের মধ্যেই। দীপকের কাছেই দেখা মিলল স্বপন রায় বিশ্বাস আর গৌতমের ।  দুজনেই ভারী ভালমানুষ, ভালোবাসায় ভরা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তাই ওদেরই মত আপনার আমার সবার বিশ্বাস দীপক বিশ্বাসেই। জানি এমত বন্ধুভাগ্য যাদের তাদের জব্দ করবে কোন সে কোতোয়াল?


  আমরা তিন বন্ধু এসে জড়ো হলাম  কোন মাইখানায় নয়, ঢাকুরিয়া লেকের পাড়ে আর স্মরণ করলাম আরেক বন্ধু গালিবকে, গ্লাসের ঠুংঠাং আওয়াজে। শেষে কি হল? শেষ বলে কিছু  তো নেই। রবি ঠাকুর লিখে গেছেন না, "আমারে তুমি অশেষ করেছ....".


আর গালিব, তাকে কি দূরে রাখা যায়? 


৷   "হাজারো খোয়াসে এইসি কি হার খোয়াস পার দম নিকলে

৷৷   বহুত নিকলে মেরে আরমান,লেকিন ফির ভি কম নিকলে।"


বুঝলেন কিছু? দরকার নেই বোঝার। আনন্দে থাকুন।

Wednesday, 1 May 2024

ভুলোমন আর হাবিজাবি

 ভুলোমন আর হাবিজাবি 


 বেশী বয়সে লোকের ভুলভাল একটু আধটু হতেই পারে কিন্তু তা নিয়ে হইচই করা বোধহয় উচিৎ কাজ হবে না। চিরদিন  কাহারো সমান নাহি যায়। এ গান কে না শুনেছেন। তবে তার মধ্যেও কেউ কেউ কেন, অনেকেই আছেন যাদের মন ওই ভুলভুলাইয়ার ফাঁদে পরা বেচারীদের মত যারা বেরোবার রাস্তাটা আর খুঁজে পাননা হাজারো চেষ্টাতেও৷ ওই ইসে, আর কি যেনোতে আটকে থেকে হাঁসফাঁস করেন  অবিরাম যতক্ষণ না কেউ তাদের উদ্ধারে নামছেন। তো আমিও সেইরকম একজন ভুলোমন আম আদমি।  এইরকম কেন, বিচ্ছিরি রকমের ভুলোমন আমার। আমি আস্ত আস্ত লোককে একদম ভুলে যায়। আজ বলে না। আমার অল্প বয়েস থেকেই। কেউ হয়ত এসেছে পুরনো আলাপের সুবাদে আর আমি কিনা তাদের চিনতেই পারিনি।  কোনজন্মে তাদের দেখেছি বলেই মনে হয় না।তখন আমার বয়স কিন্তু মাত্র ত্রিশের কোঠায়। এটা কি কোন রোগ? হতেও পারে। তবে এর পরে অন্তত লোক চেনার ব্যাপারে সেইরকম গণ্ডগোলে আর পরতে হয়নি।  আমার অবশ্য একটা  গুণ আছে, রাস্তা ঘাট ভুলে গেলেও  আমি গন্ধ চেনায় খুব দড়। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক পৌঁছে যাব সঠিক গন্তব্যে। অনেকটা স্নির্ফার্স ডগের মত। ঠিক ওরা যেমন খুঁজে পেতে কোথায় লুকোনো ড্রাগ ঠিক বের করে ফেলে। আমি অবশ্য অত উঁচুদরের নয়। তবে শেখরের বাড়ি আমি ঠিক বের করে ফেলি। কষ্ট হয়না মোটেই  আর শেখর আমাদের গন্ধগোকুল।  ওর বাড়ির গন্ধই আমাকে টেনে নিয়ে যায়। এদিক ওদিক হয় না মোটেই,  কিসের গন্ধ সেটা না হয় উহ্যই থাক।


তবে ভুলোমন ব্যাপারটা আমাকে এখন আর সেইরকম জ্বালায় না। তবে ভারী দিকভ্রষ্ট লোকও আমি।  উত্তর দক্ষিণ, বাম ডান বোধ নেই একরকম৷ বেশীরভাগ সময়ই আমি উলটোপথে হাঁটি। সেদিন তো দেখলেন নাকতলা পোস্ট আফিসের বদলে আমি উলটোপথে হাঁটা লাগলাম।  তবে শুধরে নিই ঝটপট।  আর রাস্তাঘাটের মানুষ জনেরাও ভারী উপকারী৷ আমার ভুল বুঝতে পেরে তারা ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে। তাই মানুষের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। সে আপনি ভার্চুয়াল বলুন আর যাই বলুন। আর বিশ্বাসের উপরই তো আমাদের জীবনের  অস্ত্বিত্ব দাড়িয়ে আছে, তাই না?  'জয় বাবা ফেলুনাথ' এর  ছোট্ট রুকুর মত যদি বলতে পারেন ' সব সত্যি, মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি আর ডাকু গন্ডারিয়াও সত্যি। সত্যকে মেনে নেওয়ার সাহস যদি থাকে তাহলেই জীবনে আনন্দ আপসেই চলে আসবে। কোন টেনশন থাকবে না বস।


তবে যাই বলি  আর তাই বলি এটাও তো ঠিক,  কিছু মানুষ নানা রোগভোগের শিকার হন তার মধ্যে আলঝাইমার্স, ডিমনেশিয়ার মত দুরারোগ্য রোগও আছে।  তাদের জন্য অবশ্য একটা টোটকা আছে। সেটা হল ঘুম থেকে উঠেই টাং টুইস্টিং গোছের একটা জিভের ব্যায়াম। জিভ দশবার ডান দিক দিয়ে ঘোরাতে হবে আর দশবার বা দিক দিয়ে। তাহলেই আপনি মুক্ত এই ডিমনিশিয়া বা আলঝাইমার্সএর শঙ্কা থেকে। শুধু তাই নয়, পূর্বজন্মের স্মৃতিও নাকি এসে হানা দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে,আমিও কয়েকদিন করেওছিলুম। কিন্তু সাতসকালে আয়নায় নিজেকে জিভ ভেঙাতে কার ভাল লাগে? তাছাড়া ভেবেও দেখলাম কি দরকার এ সবের। এই পড়ন্ত বেলায় সব কিছু আঁকড়ে ধরে কার কি লাভ। ভুলে যাবার মত ভাল ব্যাপার আর কিছু আছে নাকি? ' কা তব কান্তা, কস্ত্রে পুত্র' এটাতো জানেন আর মানেনও নিশ্চয় । কেউ কাউরির নয়, এ যে জীবনের মোক্ষম সত্য। তাই মন মিছে কর কেন প্রবঞ্চনা? আমি বলি কাজ কি এতসব ব্যায়ামের।  দরকার কি এতসব মনে রাখার।  আলঝাইমার্স না হোক ডিমনেশিয়া হয়ে সব ভুলে গেলেই বা  মন্দ কি । এখন এ সংসারে আপনি বাড়তি আসবাব ছাড়া, আর কিছু তো নন। 


তাই ভুল যান সবকুছ,

 তারপর বেরিয়ে পড়ুন এই মায়ার গন্ডী ফেলে। পেছন ফিরে যদি তাকান,তবে দেখবেন আপনার পেছন পেছন আসছে পাড়ার কটা ন্যাওটা কুকুর। ছেলে, বউ কেউ নয়। বড়রাস্তা পর্যন্ত পৌছে দেবে তারা আপনাকে। যদি কেউ থেকেও যায় আপনার সাথে তাহলে জানবেন  সে সাক্ষাৎ ধর্মরাজ, কুকুরের ছদ্মবেশে, আপনার এসকর্ট হয়ে চলবে একদম অমরাবতীর দোরগোড়া পর্যন্ত। তাই আজ থেকে যদিও ভুলেও যান কিছু, চিন্তা করবেন না, আরো বেশী করে ভুলুন। ভুলেই যান সবকিছু।তাহলে পাখোয়াজ বাজিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে আর গাইতে হবে না, ' শেষের সে দিন ভয়ংকর। '

Friday, 19 April 2024

গুষ্টিসুখ

 গুষ্টিসুখ।


আজ অনেকদিন পরে গুষ্ঠিসুখের আনন্দ ফিরে পেলেম। আমরা যখন স্কুলে,অফুরন্ত বন্ধু আর  হইচই,দুচোখ ভরা স্বপ্ন আর স্বপ্ন আর অজস্র হাতছানি। তখনই জেনেছিলেম গুষ্টিসুখ কাকে বলে। পরে সেই জানা আরও গভীর হয়েছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা পড়ে। 


আমাদের কৈশোরের সঙ্গী ছিল অনেকেই। তার মধ্যে  একজন চে আর অন্যজন অবশ্যই মুজতবা আলি। তো এই গুষ্টিসুখের প্রথম পরিচয় মুজতবার লেখা থেকেই। গুষ্টিসুখ যে তার আগে ছিলনা,  তা নয়। তবে সেটা যে গুষ্টিসুখ সেটা প্রথম বুঝলুম মুজতুবা আলির লেখা পড়েই।  হাজারদুয়ারির সিঁড়িতে বসে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে ভাগাভাগি করে সুখটান, চারুকে নিয়ে ভাগাভাগি, সে গুষ্টিসুখ হয়ত আজ আর ফিরে পাব না। তবে তাই বলে হারিয়েও তো যায়নি।  তার আগে বলি চারুকে কেউ ভুল বুঝবেন না। একটা সময়ে আমাদের প্রিয় ছিল 'নষ্টনীড়ের চারুলতা আর চারমিনার সিগারেট।  আমরা চারমিনার কে আদর করে বলতেম চারু। ঠিক ভুপতির মত। আমাদের আর কেউ নেই 'চারু তো আছে।' সেই কালও নেই। নেই সেই চারমিনারও। আর সেই ছেলেবেলা সে তো ছিল কোন কালীদাসের কালে।


তবুও এই বৃদ্ধ বয়সে, বৃদ্ধ বলব না, বড্ড বাজে শোনায়। আসলে পালটে পালটে নিলে, কেউ বুড়োই হয়না কোনদিনই। এই পরিণত বয়সে বন্ধুর অভাব পরেনি আজও।  সেইরকম বন্ধুরা মিলে জড় হয়েছিলুম বেশ কিছুদিন বাদে। শেখর বেশ কিছুদিন বাদে আবার এলো দিল্লি থেকে। সেই উপলক্ষেই আজকের জমায়েত ।  জমজমাট, খাদ্যে ও পানীয়তে। তার রঙে, যদি লালের আধিক্য কেউ দেখেও থাকেন, দোষ নেবেন না প্লিজ।  এতে যেটুকু গুলাল যেটুকু নেশা সব সেই পুরোন দিনকে মনে রেখেই। তেমনি নিষ্পাপ, তেমনি অমলিন।  সারাটা দুপুর বেশ কাটলো গল্পে, গল্পে, এলোমেলো আর অপরিণত কথায়। আসলে আমরা কেউই তো বড় থুড়ি বুড়ো হয়নি। শেষ বলেও কি কিছু হয়? যা হয় তা রুপান্তর। মানিয়ে নিলেই বেশ ছিমছাম। মনে হয় শেষ হয়েও না হইল শেষ। বন্ধুত্তের আকর্ষন ও তেমনই। গুষ্ঠীসুখের থেকে বড় সুখ যে আর কিছু নেই। সে যে পুরোন হয়ে যাবার জড়ত্ত্বকে ধুয়ে মুছে ফেলতে পারে একনিমেষে।

Wednesday, 17 April 2024

এলোমেলো কথা

 পুনশ্চ

এলোমেলো কথা


বলছি বটে আমার কথা। কিন্তু আদপে আমার কোন কথাই নেই৷ ফেসবুকে ইদানিং দুচার কথা লিখে ফেলি। কিন্তু সেগুলো শুধুই কথার কথা। সেসব কথার কোন মানে নেই,মুল্যও নেই। আমার কিছু কাছের জন আছে যারা দূরে হলেও আমায় ঠিক মনে রাখে মানে মনের মধ্যেই রাখে। তারা আমার এই সব বেচাল কথায় ভারী বিমর্ষ হয়। এই কদিন আগে লিখেছিলুম ইতালির এক আঙুরবাগানের সুন্দরীর কথা যার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল প্রেম হওয়ারও ছিল,কিন্তু সেটা আর ঘটেনি৷ বাংলা ব্যাকরণে কি সব কথা আছে না 'ঘটমান অতীত',  আমারটা সেইরকমই অনেকটা। তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা অঘটমান। মানে ঘটা উচিৎ ছিল কিন্তু ঘটলনা। কি আর করা যাবে। আসলে মনের মধ্যে কতরকম ছবি ফুটে ওঠে কেউ কেউ মনে রাখে, কেউ উড়িয়ে দেয় ফুৎকারে।  এসব ব্যাপারে আমি ভীষণ সঞ্চয়ী। মনের এই সব ফুলগুলোকে তরতাজা করে রাখি। মাঝে মাঝে তার সুবাস,সৌন্দর্য দুলিয়ে দিয়ে যায়। আর সেই দোলার ভাগ আপনাদেরও দিতে চাই। আর তাতেই কেউ কেউ মনক্ষুন্ন হয় বলে এত বয়স হল তবু্ও অশোকের জ্ঞানগম্যি হল না।

সত্যিই তো বয়স হয়তো অনেক হলো। জীবনানন্দের ভাষায়, " জীবন গিয়াছে চলি  আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার,তখন হটাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার...!   কবে পেরিয়েছি তিনকুড়ি। তিনকুড়ির কথায় মনে পড়ল আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি গাঁ গঞ্জের অনেকেই কুড়ির বেশি গুণতে পারত না। তাদের সব হিসেবই, কুড়ির গুণিতকে। যেমন তিনকুড়ি দশ,পাঁচ ইত্যাদি ।  এইরকম হিসেব। আমিও  সেরকমই একজন অজ্ঞানী।  আমার সব কুড়ির হিসেব। জ্ঞানী লোকেদের অনেক চোখ। চারিদিকে তাদের ক্ষর দৃষ্টি।  তারা অনেক দূর অনেক গভীরে দেখে । আমি কিন্তু মায়োপিকের দলে। বেশী দূরে দেখি না। আসলে আমি কুড়ির বাইরে বেরোতে চাই না। কুড়িই আমার জন্য যথেষ্ট। এর বেশি হলে সত্যি সত্যিই আমি বুড়িয়ে যাব। আর কেই বা বুড়ো হতে চাই। ওই জন্যই আমার পিঠে বেধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো। যে যাই বলুক আমি এইরকমই। আসলে বলছিলাম না মনের মধ্যে অনেক ছবি আঁকা হয় যা থেকেই যায়, মোছে না কিছুতেই। রবি ঠাকুরের ছিন্নপত্রের এক লেখায় এইরকম ইতালির এক আঙুরবাগান আর কিছু তরুণীর কথা পড়েছিলাম । সে ছবি কখন যেন আমার মনের মধ্যে ঢুকে গেছে আর আমিও সেই ছবির একজন হয়ে গেছি। আর তা নিয়েই যত অঘটন। রমেশ বলল এই বয়সে বউকে জড়িয়েই বেঁচে থাকা,  ভারী মনক্ষুন্ন হল আমার এই বেয়াদপীতে। আর আমার এক তরুণী বান্ধবী বলল, যান তবে আঙুরবালার খোঁজে। খোঁজ?  সত্যিই এক গভীর কথা। আমরা কে যে কি খুঁজি তা কেই বা জানে। তবু চলা থেমে থাকে না। থেমে যাওয়া নেই আর থেমে গেলেই যে গভীর গহন অন্ধকার।  তাই চলতেই থাকুন। শত শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে যান নতুন সুর্যের সন্ধানে। এ চলার যেন শেষ না হয়।


পুনশ্চঃ ঘুম আসছিল না, তাই টাইম পাস করছিলাম। এখন ভোর হয়ে আসছে, উঠে পড়ুন,সামনে নতুন দিন।

Sunday, 14 April 2024

চড়কের মেলা

 আজ ঘুরে এলাম চড়কের মেলা ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ী আর বাজারের সামনে।  সারা বিডন স্ট্রিট জুড়ে মেলার বিকিকিনি।  মেলা কিন্তু এই একদিনই।  তবে চলবে সারারাত। দারুণ কালারফুল, রাস্টিক আর ভাইব্রেটিং। আর হবে নাই বা কেন।  বেঙ্গল রেঁনেসা'র গর্ভগৃহ তো এইসব অঞ্চলই। ভীষণ একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম জুড়ে থাকে এই সব কিছু ঘিরে৷ আর যা কিছু পুরনো তা যে ভীষণ মনকাড়া।  তাই তো বারবার ফিরে ফিরে আসি এই সব জায়গায়। পুরনো কলকাতা তার যূগপুরুষরা৷ রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র আরও অসংখ্য গুণীজন যেন চলতে থাকে আমার সাথে। আমার তো ভীষণ ফ্যাসসিনেটিং লাগে।

এবার এই চড়কের ২০০ বছর পেরিয়ে গেল। ভাবা যায়? ওয়াজেদ আলি থাকলে হয়ত আর একবার বলতেন 'সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে'। হ্যাঁ, কিছু কিছু জিনিস তো একইরকমভাবে চলছে।  আর চলবেও। এগুলো শ্বাশত।  আর শিব যে শ্বাশত সুন্দর। তার কোন পরিবর্তন নেই। 


এ উৎসব শিবের। আর হিন্দু সমাজে শিবের এক বিশেষ স্থান। শিবের পরিচয় দেবাদিদেব মহাদেব  নামে। নেশা ভাং করেন আর এখানে ওখানে পরে থাকেন। তাও মেয়েমহলে শিবের খুব উচ্চাসন। সব মেয়েরাই শিবের মত বর চান। কিন্তু দেখুন আদপে তা কিন্তু নয়। আমরা বন্ধুরা যদি নমাসে ছমাসে একটু শিবকে অনুসরণ করি তা নিয়েই দক্ষযজ্ঞ হয়ে যায়। বুঝুন শিবভক্তির হাল। শিবের পৌরাণিক কাহিনি অল্প-বিস্তর সবার জানা। তবে আপনারা কেউ কি আমিশ ত্রিপাঠীর 'Immortals of Meluha' পড়েছেন? তাতে শিব কিন্তু এক উপজাতীয় বীর। তিব্বতের ওপাড় থেকে হিমালয় পেরিয়ে কাশ্মীরের ওপর দিয়ে এসেছেন সিন্ধু উপত্যকার এক রাজার আমন্ত্রণে তার রাজত্ব রক্ষার্থে।  সেই রাজাই দক্ষ আর রাজকন্যে পার্বতী। মাঝে বিস্তর ঘটনার ঘনঘটা।  তাতে শিবের বীরত্ব,মহত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত।  পড়তে বেশ লাগে। হাতে পেলে পড়ে নেবেন বইটা। 


যাহোক, চড়কের মেলা কিন্তু একই চেহারায়৷ সেই গ্রাম্য আদলের মেলা আর চড়কের বাই বাই ঘোরা৷ এর মধ্যে একজায়গায় খুব ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভীড় ঠেলে দেখি সব আমার ভীষণ প্রিয় প্রিয়দর্শিনীরা রসের সাগরে ভাসছেন just আমার অপেক্ষায়।  কি করলাম? কিছুই করতে পারলাম না। শুধু ছবি তুলে ফিরে এলাম। তারা কারা, শুনবেন?  জিলাবি, পান্তুয়া, ক্ষীরের চপ, বালুসাই ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে তাদের ছবি  তুলেএনেছি আপনাদেরই জন্য। ছবি দেখেই বুঝবেন কি মোহময়ী তাদের আবেদন,সঙ্গে সঙ্গে আমার সংযম কেও সাবাসী দিতে ভুলবেন না।

Sunday, 7 April 2024

বিলে

আজ সকাল সকাল যেতে হয়েছিল বিষ্টু ঘোষের পাড়ায়। কি দরকারে সেটা না হয় নাই বললাম। আর সবকিছুই যে ঢেরা পিটিয়ে বলতে হবে এমন পেটপাদলা আমি নয়। আর সে সব শুনেও আপনাদের এমন কিছু বেম্মজ্ঞান হবেনি। আখড়ার কাছেই বিলের সাথে দেখা। বিলে কে চেনেনা এ তল্লাটে এমন কেউ নেই। বিরাট শিশু বলতে যা বোঝায় তাই। যেমন বিশাল দেহ তার তেমনি বিশাল মন। একদমই অল্প বয়স।  তবে এ পৃথিবীতে বিলে জানেনা বা চেনেনা এমন জিনিস নেই। যেখানে গপ্পের গন্ধ পাবে, বিলে ঠিক সেঁধিয়ে যাবে। তখন তাকে নড়াই কার সাধ্যি। মোহনবাগান অন্ত প্রান৷ ক্লাবের দুঃখে বিলের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। খাঁটি ঘটির বাচ্চা। ক্লাবের হয়ে জান লড়িয়ে দেবে। যেখানে মো'নবাগান সেখানেই বিলে হাজির সে শিলিগুড়ি হোক বা চেন্নাইই। সেই বিলের বড় দুঃখ।  কবে বিএ পাস দিয়েছে আজ পর্যন্ত একটা ভদ্রস্থ চাকরি জুটল না। যে কথা বলছিলাম।  বিলে ধরল গে ঠিক শ্রীমাণির বাজারের মুখটাতে। ও আমাকে জ্যেঠু বলে ডাকে। বলল জ্যেঠু, শুনেছ, শম্ভু কাকা তোমায় কিছু বলেছে? আমি বলি না তো রে বিলে,কি হয়েছে? বলে  বলেনি? তাহলে থাক, জানলে শম্ভু কাকা আমার উপর রাগ করবে। আমি বলি বলে ফেল না আমি আর শম্ভুকাকা কি কিছু আলাদা। এক মুহুর্তেই বিলে সব উগরে দিল ওর ক্ষোভ দুঃখের কথা। শম্ভুকাকা যে কাজটা ওকে যোগাড় করে দিয়েছে, সেটা ওর মোটেই পছন্দ নয়। ও তাই ঠিক করেছে, চাগরীটা ছেড়েই দেবে।
আপনারা শুনলেন তো বিলের কথা। ভারী ভাল,সরল, সৎ ছেলে। দেখুন না যদি ওর জন্যে ভদ্রস্থ কিছু চাকরীর জোগাড় হয়। আমার অনুরোধ রইল।

বিলের সাথে গপ্পে কেটে গেল অনেকটা সময়। একটু মার্কেটিংও করলাম, জানেন। বিরাট কিছু নয়। আমার পছন্দের ধুলো শাক,সজনের ফুল আর মাছের মধ্যে কাঁচকি আর ফলি। আমার বাজারের সওদা শুনে জানি অনেকেই মৃদু মৃদু হাসবেন। হাসুন। তাতে আমার বয়েই গেল। আমার আজকের মেনু সজনে ফুলের বড়া,ধুলোর শাক, কাচকি র চচ্চড়ি আর বড়ি দিয়ে ফলি মাছের ঝোল। ইচ্ছেটা পেশ করলাম। জানিনা শেষ পর্যন্ত পাতে পড়বে কিনা।

গেঁয়োখালির কড়চা

 গেঁয়োখালির কড়চা


অশোক রায় 


সামতাবেড়ের শরৎবাবুর গ্রামের মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই ননীর ডাক এল গেঁয়োখালি যাবার৷ এর আগে শরৎবাবুর রুপনারায়নের কোলে তার গ্রাম আর রুপনারায়নের রুপে আমি মজে গেছি৷ ওই যে কে যেন লিখে গেছেন না, রবিবাবু নিশ্চয়, " রুপনারানের কুলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ সত্য নয়"! আমারও ওইরকমই একটা উপলব্ধি হল। আগে গ্রাম সম্মন্ধে আমার নাক সিঁটকানো একটা  ব্যাপার স্যাপার ছিল। সেটা একদম কেটে গেছে। তাই গেঁয়োখালি যতই গেঁয়ো হোক না কেন। আমার কোন আপত্তি নেই তার সঙ্গ করতে। তাই রাজী হতে সময় নষ্ট করিনি মোটেই।  এ গ্রাম আবার যেখানে সেখানে নয় গঙ্গা, রুপনারায়ন আর সমুদ্রের ত্রিবেণী সঙ্গমে। তাছাড়া গেঁয়োখালি নিয়েই আমার একটা মনখারাপ ছিলই। আপনার সবাই জানেন, একটা বাচ্চা ডলফিন তার সঙ্গ ছেড়ে এসে পরেছিল গেঁয়োখালি নদীতে। বাঁচান যায়নি। কি করেই বা বাঁচে সমুদ্র থেকে এসে এই ছোট নদীতে?


যা হোক, শেষমেশ উঠেই পড়লাম হলদিয়া লোকালে। লোকাল শুনে ভুরু কোঁচকাবেন না। এ লোকাল কিন্তু পক্ষীরাজকেও হার মানায়। কিছুটা দৌড়ে আর  উড়ে পৌঁছে দিল সতীশ সামন্ত হল্টে। এই হল গেঁয়োখালির স্টেশন। এখান থেকে টুকটুক। আমরা ৬ জন। ও হো সবার সাথে আপনাদের পরিচয় করানো হয় নি। আমাকে তো চেনেনই।  একজন আম আদমি।  আজকাল আম আদমি কথাটা বেশ খায় পাবলিকে। আম আদমি কিন্তু বেশ শক্তি ধরে। তাই আমাকেও হেলাফেলা করবেন না। আর আমাদের দল মানে "ননীগোপালের দল" যার আমরা লাইফ মেম্বার তার সেনাপতি"ননী"। আছে তরুণ যেমন লম্বা তেমনি চওড়া আর যাত্রাদলের রাবণের মত পিলে চমকানো গলার আওয়াজ আর এক এক চুমুকে সুরা কি সমুদ্র শুষে নেবার অসীম ক্ষমতা। আছে সুব্রত। ভারী হিউমারিস্ট ছেলে, আর বড়ো শিব, চন্দ্রনাথ।  চন্দ্রনাথ এর পরিচয় এখন উহ্যই থাক। এক লাইনে শেষ হবার নয়, ওর পরিচয় দেব যথাসময়ে, যথাস্থানে।  গৌতম কে সবাই তো আপনারা চেনেনই। আমরা সঙ্গী ছিলাম টাইগার্স নেস্টের চুড়োয় ওঠার সময়। ভারী ভালোমানুষ।  বারবার আমায় তার রাঁচীর বাড়ীতে যেতে বলেন। এবার যেতেই হবে। পাগলা গারদ বলে এতদিন এড়িয়ে গিয়েছি। এবার যাবোই যাব।


সবার পরিচয় তো পেলেন, এবার সামনে এগোই।  টুকটুকে করে টুকটুক করে পৌঁছে গেলাম হলদিয়া পোর্ট অথোরিটির গেষ্ট হাউসে। দারুণ ঘর, দারুন লোকেশন আর দারুণ দারুন ব্যাবস্থা।  এত সব দারুণ যখন, দারু কি অনুপস্থিত থাকতে পারে। ননীর এ সব ব্যাপারে ভারী উঁচু নজর। একদম ব্লু ক্যাটাগরির ব্যবস্থা। সঙ্গে মাছ, সোহাগি আঁচে ভাজা, ওপরে সোনালি আর ভেতরে নরম অনাস্বাদিত স্বাদ। এই পর্ব চলল যেমন চলে। এসব বলে বোঝানো যাবে না। যে জন জানহ 

 করহ সন্ধান। দুপুরেও হল জম্পেশ খাওয়া দাওয়া। তারপর সেলিমের টুকটুকে লঞ্চ ঘাট আর লঞ্চে চেপে গাদিয়াড়া। গাদিয়ারা লোকে কেন যে যায়? হতাশ হতে হল এর ছিরি দেখে। 

ফিরে এসে আবার আড্ডা আবার মৌতাত। বেশ জমজমাট আড্ডা চলল রাত পর্যন্ত।  রাতে দেশী মুরগীর পাতলা ঝোল।  আর কি চায় জীবনে?  এইরকম গড়িয়ে গড়িয়ে রসেবশে কেটে যাক জীবন। চাই নে মা আমি রাজা হতে।


এর পর?  এর পর শিব্রামের সেই বিখ্যাত উক্তির মত " ঘুম,  ঘুম থেকে উঠে বিশ্রাম আর রাবড়ি। " আমাদেরও চায়ের পর রাবড়ি(?) দিয়ে শুরু। বাইরে এলে আমরা ঠিক সকাল সন্ধ্যে মানি না। চলে মানে চলতেই থাকে রসে আর বশেও। বাড়াবাড়ি একদম নয়। পরের দিন অনেক কিছু দেখলাম টুক টুক করে। সুন্দর সবুজ গ্রাম।  গ্রাম আর সেই গ্রাম নেই চকচকে রাস্তা। মানুষজন, ঘরবাড়ি সবই বেশ চকচকে৷ গ্রামের মানুষেরা বেশ ভালই আছেন, সচ্ছল, সচ্ছন্দ। বেশ ভাল লাগল দেখে। চার্চ, রামকৃষ্ণ মিশন, মন্দির, মসজিদ সব বেশ আছে পাশাপাশি।  ফেরার পথে মহিষাদল।  মহিষাদল রাজবাড়ী তো সবাই দেখেছেন। কিন্তু খেয়েছেন কি "সুরভী " তে? খাবেন একবার। আমি একটু খাওয়ার গপ্প করতে ভালবাসি। কি খেলাম শুনুন। ভাত তো বটেই সঙ্গে করলা ভাজা, মুগের ডাল,আলুভাজা, বেগুনের ঝাল(অনবদ্য), পাঁচমিশেলি সব্জী, পুকুরের চিংড়ি অনবদ্য স্বাদ, নরম আর মাথাভর্তি ঘিলু, চাটনি, পাপড় আর মিষ্টি মিষ্টি দই। ভাল না? যা হোক সব ভালোরই শেষ থাকে। যা যা বলা হল না দেখে নেবেন ছবিতে।  ফেরা সেই পক্ষীরাজেই। দু'ঘন্টায় হাওড়া। শেষ হয়েও হবেনাকো শেষ। সামনের শুক্কুরবার আবার শুরু। এবার লম্বা ট্যুর। বিরাট দল। দল সেই একই। আমাদের আস্থা "ননীগোপালের দলেই"!

Saturday, 6 April 2024

পান্তাভাত ও চোদ্দ ভূতের বাড়ী

 পান্তাভাত ও চোদ্দ ভূতের বাড়ী


মনে আছে তো সেই পুরনো হিন্দি গানটা?

"ডর লাগে তো গানা গা, ডর লাগে তো গানা গা" পুরনো হিন্দি সিনেমা। 

সত্যিই ভয় ভয় একটু লাগছে। শুধু আমারই না সবারই বোধহয়।  কেন সে তো সবাই জানেনই। তার নামটাও মুখে আনতেও গা ছমছম করছে। তবে কিনা ফুলবাগানের এই যে বাড়ীটা যেখানে আমরা থাকি তা ভুতেরই বাড়ী। চোদ্দো ভূত, মানে চোদ্দোজন ভুততুতো ভাই, বোন।সব ভুতের আলাদা আলাদা করে আজ আর পরিচয় দেবার অবকাশ নেই। মেছো ভুত,গেছো ভুত, বাঙাল ভুত,ঘটি ভুত হরেক রকমের ভুত সব।একটা গুহ্য কথা বলি? বাঙাল ফিমেল  ভুতেরা ভারী লড়াকু কিন্তু , আর গলায় ভারী তেজ। এদের তেজেই কিনা জানিনা, রায়, দত্ত মিত্রের দল ভারী কোনঠাসা। কিন্তু এখন সব ভুতই অদ্ভুত আচরণ  করছে, কাজকর্ম তো শিকেয়। ভুতের দল সব তিনতলার চিলেকোঠায় পা দুলিয়ে বসে একসুরে গাইছে। ওই যে বললাম, ডর লাগে তো গানা গা। আর একের পর এক চলছে, চায়ে পে চর্চা, বুজবুজের আসর, চুলকাটার সেলুন। এসব চলছেই এবেলা ওবলা। 


তবে আজ বসেছিল একটু অন্যরকম আসর। লাঞ্চে আজ গুষ্টির শান্তিকল্পে  ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা, চিল চিল পান্তাভাতের আসর। গোটা বাড়ীর পাত পড়েছিল একসাথে। সবাই গপগপ নয় সপসপ করে খেয়ে নিল । নেবু,নঙ্কা আর পেয়াজুঁ দিয়ে। সঙ্গে আলুচোখা আর কালকের আমডাল,  বেশ লাগল কিন্তু। বেশ জোস এসে গেল। ইমুইনিটি যেন একধাক্কায় বেড়েই গেল অনেকটাই। মনে হল হাম হঙ্গে কামইয়াদ। এই বন্দীদশার ভয় কাটাতে আর কি কি চাই? পান্তাভাত আজ সুপারডুপার হিট। আমি বলি কি আপনারাও বসিয়ে দিন পান্তাভাতের আসর। এতে শুধু সময় আর পরিশ্রমই বাঁচবে না। বাড়বে আপনার ইমুইনিটি আর লড়াই করার জোশ। আর যেটার স্টক আপনার প্রায় শেষ, সেটাও পেয়ে যাবেন পান্তাভাত আর কদিন জমিয়ে রাখলেই। তখন আপনি আহ্লাদে গড়াগড়ি যাবেন নির্ঘাৎ।  তবে আমাকে দুর থেকে আর্শীবাদ করতে ভুলবেন না। আর যাই ভুলুন, ভুলবেন না safe distacing.. ঠিক কিনা?

ভবানীদার গল্প

 



ভবানীদার গপ্প


কতই বা বয়স হবে আমাদের  তখন ১৪/১৫,  তার বেশী নয়। এমন কিছু আগের নয়। আসলে এখন ৫৩/৫৪ বছর সময় আমার কাছে কোন সময়ই নয়। নেহাৎই কালকের কথা। সময়ের হিসেব একেবারে পালটে গেছে। আর পালটানোর আসল হোতা হচ্ছে ছোটকা। ছোটকা কিন্তু আমার কাকা বা জ্যাঠা কেউ নয়। ছোটকা আমাদের ফ্যামিলির সবচেয়ে ছোট সদস্য। তাই আমার কাছে কখনও ও ছোটকা, কখনও বা টুটুম। ওর আর একটা নাম আছে যেটা আমার এক্কেবারে পছন্দ নয়। আর সেইজন্য সেটা নিয়ে আমি পাঁচ কান করতেও চাইনা। তবে যা বলছিলাম ৫০/৫৫ বছর কেন আমার কাছে, কোন সময়ই নয়? কারণ আমার সাথে টুটুমের যা কিছু গপ্পসপ্প, সব আলোকবর্ষের হিসেবে।  এই মহাবিশ্ব নিয়ে ওর ভারী আকর্ষণ। রাত্রে ও আমার পাশে শুয়ে ওর প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসে।আর ওর সব কিছু প্রশ্নই এই আকাশ  আর বিশাল মহাবিশ্ব ঘিরে। ও ওর দাদুকে ভাবে ভারী পন্ডিত গোছের কিছু।তাই আমাকেও ওর প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তৈরি থাকতে হয়। চন্দ্র, সূর্য্য, তারা শুধু নয়। ওর আকর্ষণ আরো গভীরে।  নোভা,সুপারনোভা, নিউট্রন, নেবুলা আর এখন শুধু ব্ল্যাকহোল।  আর এ সবের মূলে কিন্তু ইউটিউব। কম্পিউটারের পর্দায় ওর দেখার বিষয় হল এই সব মহাজাগতিক বিষয়। ওটা নিয়ে ওর ভয় ও ভাবনা দুটোই আছে। ব্ল্যাকহোল কতদুরে? সব আলোকবর্ষের হিসেব। কত মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে সেটা বুঝতে, বোঝাতে আমার ভারী মাথা খাটাতে হয়। তবে আমরা দুজনেই একসময় পৌঁছে যায় ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায়। ওর ভারী ভয়, ওর দাদু যেন হারিয়ে না যায় ব্ল্যাকহোলের অতল গভীরে। আমি বোঝায় ভয় কিসের, ব্ল্যাকহোল দিয়ে ঢুকে ঠিক বেরিয়ে আসব হোয়াইট হোল দিয়ে।  জীবনও তো তাই। জীবনের অজস্র ফুটোফোটার ব্লাকহোল পেরিয়ে বাঁচবার পন্থা নিশ্চয়ই আছে। শুধু পথটা চিনে নেওয়া চাই। হোয়াইট হোল তো আমাদের সবারই অপেক্ষায়। 


বলতে যাচ্ছিলাম আমাদের নবাব বাহাদুর স্কুলের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ভবানীদার কথা, চলে এলাম বহুদুরে। তবে এ পথ পেরোতে আমার সময় লাগবে না মোটেই।  কল্পনার দৌড় থাকলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভারী হাত ধরাধরি ভাব। তাহলে শুরু করি? সে একটা দুষ্টু মিষ্টি গল্প। ভবানীদা ছিলেন আমাদের কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট।  আর আমার বয়সী ছেলেদের হাত দেখতে তার বেশ আগ্রহ। বেশি কিছু লাগত না। স্কুল ক্যানটিনে একটা চা, বিস্কুট খাওয়ালেই ভবানীদা ভারী মনোযোগ সহকারে  আমাদের হাত নিয়ে বসে পরতেন তা নিরীক্ষন করতে। আর আমাদের বয়সী ছেলেদের মনের গতি প্রকৃতি তার ভারী জানা। বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে বলতেন, 'বুঝলে নিলু, একজন তোমাকে খুব পছন্দ করে।" ১৫ বছরের নবীন হার্টও সে অচেনা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশীর সম্ভাবনায় ধড়ফড় করে ওঠে। ' স্কুলে আসার পথে দেখবে তো ভাল করে, একটা বিনু দোলানো মিষ্টি মেয়ে তোমার দিকে আড়চোখে তাকায় কিনা?' যদি তাকায় তবে জানবে ওই সেই মেয়ে। আতিপাতি করে খুঁজে ফিরি? কে সেই মেয়ে। ডলি,মঞ্জু, চায়না?  কে সে? সেটা যে আড়চোখে তাকিয়েই জীবন নদীতে অবগাহনের সময়।  সেই অবগাহন আজও তো শেষ হয়নি। যদিও জানি, ব্ল্যাকহোলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি তবুও হোয়াইট হোলের রাস্তাওতো আমার জানা৷ ঠিক পৌঁছে যাব জানি একদিন।

Friday, 5 April 2024

জীবন পাত্র উছলি উঠেছে

 ...জীবন পাত্র উছলি উঠেছে...


রোববার আমার ছুটির দিন। এ দিন আমি কোন চেনা রাস্তায় ঢুকিনা। না করি কোন কাজ। অনেকেই বলেন, বিশ্রাম করুন। আসলে বিশ্রাম যে কি তা আমার মাথায় ঢোকেনা মোটেই। বিশ্রাম মানে যদি চুপচাপ শুয়ে বসা হয়ে থাকে তাহলে তো সে রীতিমতো অত্যাচার।  তাই বিশ্রাম মানেই আমার কাছে অচেনা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। বা ধরুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, বই পড়া এইসব। এই রোববার ঠিকই ছিল ভবানীপুরে সুজিতের বাড়ী যাব। সুজিতের জন্মদিন গেছে কদিন আগে। তাই সুজিতের বাড়ীতেই আমি আর পল্টা পৌঁছে গেলাম সময়েই। সুজিতের দাদা সুব্রতদা আমাদেরও বন্ধু। এর আগেও আমরা একসঙ্গে পঞ্চলিঙ্গেশর, বালাসোর ঘুরে এসেছি। এরকম দাদা যার আছে সেই ভাইয়েরা কেউ খারাপ হতেই পারে না। তাই আমরাও কেউ খারাপ নয়। ভারী সুশীল আর সজ্জন। আর সুজিতের কথা,  'কেয়া কহেনা'! এরকম বন্ধু যার আছে, সে ওর ঘাড়ে সব ভার চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। সুজিত সব সামলে নেবে।  সুব্রতদার সাথে অনেকদিন বেরোন হয়নি সেইরকমই আর একটা প্রোগ্রাম চটজলদি ফিক্স হয়ে গেল,পুজোর পরে পরেই। এবার ননীর সাথে বসে একটু ফাইন টিউন করতে হবে। এখন আমাদের প্রতি মাসেই বাইরে যাবার আমন্ত্রণ।  নদী পর্বত, জল জঙ্গল পরিক্রমা চলবে প্রায় প্রতি মাসেই। 

সে যাই হোক, সুজিতের বাড়ী যখন গেছি জন্মদিনের অজুহাতে ও কি আর ছাড়বে মিষ্টি ছাড়া। ভবানীপুরের অলিতে গলিতে মিষ্টির দোকান।  তাই থালা ভর্তি মিষ্টি নিয়ে হাজির সুজিতের ঘরণী। আমার আবার খেতে ভাল  লাগে না,  তাই মিষ্টি। ভাগ্যিস পল্টা ছিল, তাই ওর প্লেটে অর্ধেক চালান করে হাল্কা হলুম। বাকীটা দিলুম সুজিতকে।


সুজিতের বাড়ী ছেড়ে গন্তব্য এবার  সেই মাইখানা যেখানে গালিব, ওমর খৈয়ামের মত গুণী জনেরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন।  আমরাও চললাম তাদের পথ ধরেই।  এবারও আড্ডা, তবে ঠোঁট ছুয়ে ছিল সিরাজীর পেয়ালা। তবে সুজিতের আজকাল বড়ই ছোয়াছুয়ির বাই , লিমকা ছাড়া কিছুই হাতে নেয়না। অবশ্য তার একটা কারণও আছে, যেটা সুজিতকে আরও দায়িত্বশীল করেছে।  তিন ঘন্টা তর তর করে কেটে গেল। আজকে অরুণ আর বড়ভাই বলরামেরও আসবার কথা ছিল।  বলরাম চারমাসের জন্য বিদেশে চলে যাবে তাই ব্যাস্ত,  শেষমুহূর্তের ব্যাস্ততা ফেলে আসতে পারল না। বলরাম না থাকলে আমাদেরও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সংসারের বড়ভাই না থাকলে যা হয়। একটা সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি ঘিরে থাকে ছোট ভাইদের ঘিরে।


আজ যখন জীবনে কি পেয়েছি বা পায়নি, তার হিসেব মিলাতে বসি, তবে দেখব পাওয়ার ঘড়াই পরিপূর্ণ।  বন্ধুর মত বন্ধুরা এসে হাত ধরেছে। অনেকেই বলে জীবনের পথ বন্ধুর।  কিন্তু বন্ধু যদি থাকে তাহলে কোন পথই বন্ধুর মনে হয় না।  একবার বর্ষার গঙ্গা সাঁতার দিয়ে পেরোতে গিয়ে গঙ্গার খরস্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম তখন আমার ছোটবেলার দামাল বন্ধু সতুই আমার রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছিল। তাই আজও এই পৃথিবীর বুকে ভেসে আছি। জীবনের সব পর্যায়ে বন্ধুত্বের হাতছানি ডাক দিয়েছে। অপু, পন্ডিত, ছোটে নবাব, পাপ্পু নবাব, আলিবাম, মীজানুর এরা সবাই সুধায় দিয়েছে ভরে এই জীবন,তাই এত সুন্দর এই পৃথিবী।   আজ হয়ত তারা অনেকেই ছিটকে গেছে।

কিন্তু বন্ধুর আসন অপুর্ণ থাকেনি। আমার বড় কালের বন্ধুদের তো অনেকেই চেনেন। সুজিত, পল্টা, অরুণ, বড়ভাই বলরাম, আরো অনেকেই। তাই জীবনপাত্র পরিপূর্ণ।  কোন অভাব নেই, অভিযোগ নেই। বন্ধুত্বের মাধুরীতে সব অভাব গেছে ধুয়ে মুছে।

আমার ছোটবেলা

 


আজ অস্তাচলের পথে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বড় মনে পড়ে। আমার শহর,আমার মা, আমার বাবা, ফেলে আসা ছোটবেলার বন্ধুদের কথা স্পষ্ট মনের পর্দাই ভেসে ওঠে। একেবারে জীবন্ত যেন কালকের দেখা ঘটনা। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া যাবে।কিন্তু তা তো নয় তাদের অনেকেই যে আজ অদৃশ্যলোকের বাসিন্দা। হাজারো ডাক। হাজারো হাহাকারেও তারা স্তব্দ হয়েই থাকবে। দেয়ালে টাঙানো ছবির মতই। 

আমার শহরের নাম অনেকেই জানেন মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ।জঙ্গিপুর মহকুমার সদরশহর। এখন জঙ্গীপুর আলাদা জেলা। আর রঘুনাথগঞ্জও আজ ডিস্ট্রিক্ট টাউন।  আমার স্মৃতিতে একটা ছোট্ট সুন্দর সাজানো শহর। কোর্টকাছারী,স্কুল কলেজ,অফিসপত্র সবই ভাগীরথির এইপারে অর্থাৎ রঘুনাথগঞ্জে আর ওপারে জঙ্গীপুর শহর। ধারে ভারে জঙ্গিপুর কিন্তু এ'পারের রঘুনাথগঞ্জের তুলনায় অনেক ছোট আর গুরুত্বহীন। তবে জঙ্গিপুর কলেজ কিন্তু জঙ্গিপুরেই। আমার দাদা,দিদিরা সবাই এই কলেজেই পড়ত। তখন পারাপারের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। সদরঘাটের খেয়া পার হয়ে যেত হত ওপারের জঙ্গীপুর কলেজে।

তো এই হচ্ছে আমার শৈশবের শহর রঘুনাথগঞ্জ।এইখানেই আমার জন্ম কোন এক বৈশাখের পঁচিশে।তারিখটা নিশয় চেনা চেনা লাগছে।সত্যি বলতে জীবনে এই একটা কাজই করেছি। পঁচিশের দড়ি ধরে ঝুলে পরতে পেরেছি। তাই তো সারাজীবন একটা পদ্যও না লিখে কেমন কবিগুরুর সঙ্গে ঝুলে রয়েছি।তবে কবিতা যে একেবারের লিখিনি তা তো নয়। প্রথম যখন একটা সুন্দরী কিশোরী মনের মধ্যে তোলপাড় তুলল তখন লিখেই ফেলেছিলাম। 'মঞ্জু তোমাকেই' লালবাগে জমিদারবাড়ির এক সুন্দরী কন্যার। সে অবশ্য একটু বড়কাল মানে সদ্য গোঁফ ওঠা বয়সের কথা। এ বয়সে ছেলেরা একটু এঁচোড়ে পাকা হয়। আমিও বাদ যাইনি। তো এসব কথা পরে আসবেখন। এখন শুনুন আমার ছোটবেলার ছোট কথা আর ছোট্ট শহর  রঘুনাথগঞ্জের কথা।আমাদের শহর বড় সুন্দর। ছোট্ট কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। এখনকার মত এত আবর্জনার রমরমা তখন দেখিনি। ময়লা না ছিল বাইরে না সেইসময়ের মানুষের মনের মধ্যে। আজ যখন সেইসময়ের মানুষদের কথা ভাবি, তাদেরকে যেন মনে হয় রুপকথার চরিত্র সব। এখনকার মানুষদের মত এত বিবর্ন বা স্বার্থপর নয়। 

এত সব ভাবতে ভাবতে বিষয় থেকে কখন গেছি সরে। যা বলছিলাম রঘুনাথগঞ্জ ভারী সুন্দর শহর। ভাগীরথির নদী বয়ে গেছে এর পাশ দিয়ে।এখানে আরো একটা ছোট নদী আছে, খড়খড়ী তার নাম। সে নদীতেও অনেক মাছ।একপাশে রঘুনাথগঞ্জ আর অন্যপারে জঙ্গীপুর।A tale of two cities এর মত ব্যাপার। একে অন্যের পরিপুরক।ভারী মৃদুছন্দে বয়েচলা জীবন। কোন ব্যস্ততা নেই। সবাই সবাইকে চেনে।তারা হয় কাকা,জ্যাঠা, দাদা, দিদি এইরকম আর কি। সবাই সবাইয়ের সাথে আত্মীয়তার ছন্দে বাধা। আমার তো অনেকটা Malgudi Days মত লাগে। আসলে আমাদের সবারই মালগুড়ী ডেস কোথাও না কোথাও আছে। সবার হয়ত মনে থাকে না। আমার থেকেই গেছে। কারণ আমি তো বড়ই হয়নি,ছোট্ট থেকে গেছি । সে যাইহোক আমার ছোট্ট শহরে কয়েকটা মাত্র পাড়া ছিল, খুব কাছাকাছি,ঘেষাঘেষী করে গুষ্ঠিসুখের ওম নিত সবাই। ওম কি জানেন না? এটা বোঝান খুব মুস্কিল নয়। আমার সাথে যদি আপনার দেখা হয় তাহলে ঠিক জেনে যাবেন।এবার শুনুন আমাদের পাড়াগুলোর নাম। আমাদের বাড়ী এখনও আছে ফাঁসীতলায়,(শুনে ভয় পাবেন না, আমরা অতি সজ্জন লোক, কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো আমাদের কম্ম নয়, সেসব হয়েছিল বৃটিশ আমলে,গোরা সাহেবরা কাকে ফাঁসি দিয়েচিল, সেইথেকেই এই নাম),পাঁকুড়তলা,সেখানে এখনো একটা পাঁকুড় গাছ আছে বা রয়েই গিয়েছে সেই স্বাধীনতার আগে থেকেই,বাজারপাড়া, দরবেশ পাড়া, ফুলতলা, সদরঘাট,ম্যাকেঞ্জী পার্ক,বেলেঘাটা আরো কিছু। শরৎ পন্ডিত মশাই কে মনে আছে নিশ্চয়, আরে দা’ঠাকুর।যার পন্ডিত প্রেস আজও আছে, আরে যেখান থেকে ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ আজও বেরোয়।শরৎ পন্ডিতের নামে দাদাঠাকুর সিনেমা হয়েছিল। ছবি বিশ্বাস করেছিলেন। তো দা'ঠাকুর ছিলেন আমার দুই বন্ধু রবি আর অনুত্তমের দাদু। আমি তো প্রায়ই তার বিছানার পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতুম। উনি যে এত নামকরা লোক তখন কি আর জানতুম, তবে তিনি নজরুলের কথা সুভাষের কথা অনেক বলতেন। এদের বাড়ীর কেউই কিন্ত জুতো বা চটী পরতেন না। জানিনা, সে রেওয়াজ এখন চালু আছে কিনা? জঙ্গিপুরের আর একজনকে অবশ্যি অনেকেই চিনবে, যদি সত্যজিতের সোনার কেল্লা দেখা থাকেন। তাতে ফেলুদার মুখে শুনবেন “এ তো আর জঙ্গীপুরের হরিশ পোদ্দার নয়, যে লাখ দুলাখ ফেলে দেবেন।“ 

মুস্কিল হল, রঘুনাথগঞ্জে সবাই সবাইকে চেনে, তাই কোন অপকর্ম করে নজর এড়িয়ে যাওয়া খুব মুশকিল ছিল। একবার ছোটবেলায় টিউশন ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলী সিনেমা দেখেছিলাম। শাম্মী কাপুর আর সায়রা বানুর ছবি, তখনকার দিনের খুব বিখ্যাত ছবি।ছোটকাকার চোখ এড়াতে পারি নি। ঠিক ধরা পরে গেলাম।অবশ্য তাতে ক্ষতি বিশেষ হয় নি। আমার ছোটকাকা আমাকের রিক্সা করে ছায়াবাণী সিনেমা হল থেকে নিয়ে গিয়েছিল।বাবার কানে তোলে নি, তুললে চড়চাপাটি পরতো নির্ঘাত।এ কথায় সেকথায় বড় দিকভ্রান্ত হয়ে পরছি। গুছিয়ে বলা হচ্ছে না কিছুই। তাই এবার শুরুর শুরু করি। তবে শুরুতে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি বোধহয় আমার ছোট বয়সে একটু সুদর্শনই ছিলাম।আমার বয়স তখন মাত্র ৮। আমার পাড়ার এক কাকার ইচ্ছে ছিল বড় হলে তার মেয়ে পাঞ্চালীর সংগে আমার বিয়ে দেবার। শুনে কি আনন্দই না হয়েছিল। তাই শুনে ডগমগ হয়ে বাড়ীতে ফিরেই পাউডার মেখে আমার সেই অপরুপ মুখ আয়নায় দেখে নিজেই চমৎকৃত হয়েছিলাম। ছবি আঁকতে জানলে সে ছবি আপনাদের দেখাতে পারতুম। তবে সে ছবি আমার মনের মণিকোঠায় জমা আছে আজও। পাঞ্চালীর সংগে আর দেখা হয়নি। কি জানি তাকে কোন অর্জুন নিয়ে গেছে? 


Monday, 1 April 2024

বেনারসী রাবড়ি

 লিট্টিসুন্দরী

 

"অভয় দাও তো বলি আমার Wish কি

এক ছটাক সোডার জলে,

পাক্কী তিন পোয়া হুইস্কী। "

                                 

                               

সত্যি বলতে আজ আমার ইচ্ছেটা সেইরকম মোটেই নয়, একেবারে অন্যরকম। এই গরমে  হুইস্কী মোটেই নয়।  আজ আমার ইচ্ছেটা ফুটে উঠেছে -লাল মুচমুচে রেশমি পরোটা  আর বেনারসি রাবড়ি মাখামাখি করে যেমনটি হয়, ঠিক তেমনি করে। বাকীটা ভেবে নিন। এই পরোটা যেমন তেমন নয়। এরকম পরোটা আর কাবাবের দোকান  দেখতে পাবেন ইলিয়ট রোড আর রিপন স্ট্রীটের দুপারেই। তবে এই গরমে কাবাবও বাদ দিয়েছি। তার বদলে আজ আমার পসন্দ বেনারসের রাবড়ি। 


বেনারসি রাবড়ির স্বাদ অনেকেই নিয়েছেন। যদি কেমন জিজ্ঞেস করি তবে হয়ত সবাই বলবেন, দারুণ, অপুর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাতে কি সব প্রকাশ পেল? একেবারেই নয়। তবে কেমন? বেনারসি রাবড়ি আমার বোধে হল কামনার মৃদু অগ্নিশীতল তাপে, সোহাগের সরে সরে, ভালবাসার মৃদু মন্দ মলয় সুবাসে, হৃদয়ে হাজারো ঘোড়সওয়ারের দাপাদাপি। এর সঙ্গে লাল লাল মুচমুচে পরোটা। যেন পৃথ্বীরাজ টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এসে বেনারসি সুন্দরীকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আদপে তা কি হল? একেবারেই নয়। আজ আমার টগবগানো রক্তের অনেকটা দিয়ে এসেছি ল্যাবে আমার শর্করার ঘনত্ব আরও সব সুচক মাপতে। যতক্ষণ না সে রিপোর্ট আসে ততক্ষণ কোন বাড়াবাড়িই বাড়তে দেওয়া নয়। অতএব এটা আজকে পোস্টপোন্ডই থাক। যেদিন হবে, সেদিন জানাব আপনাদের।


আজ বিষ্টু ঘোষের আখড়া থেকে বেরিয়েই বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেল। উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে উত্তম সব মিষ্টান্নের আয়োজন। নতুন নন্দ, পুরোন নন্দ, খগেনের দোকান আর তেলেভাজার অনন্ত অয়োজন।  কিন্তু সেখানে আমার ঢোকা বারণ। তাই আজ লিট্টিসুন্দরীতেই আত্মসমর্পণ।  সুকিয়া স্টীটের মোড়ে গরম গরম লিট্টি, আলুর চোখা আর চাটনি দিয়েই ভেতরের আগুনটাকে আয়ত্বে আনলাম।  একটু রাস্টিক, দেহাতী গন্ধ মাখা। কিন্তু গরম গরম বেশ লাগে। একদিন সেবা নিয়ে দেখবেন।

Monday, 18 March 2024

 আজ লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলুম ভক্তি বড় না সত্যি। অখন্ড ভক্তি, বিশ্বাস, আনুগত্য এগুলো আমার কাপ অফ টি নয়। সত্য আর পরিবর্তন এর কি কোন বিকল্প আছে?  নেই, অন্তত আমার কাছে।  আজকাল চলতে ফিরতে বা নির্জনে বসেও সেই সত্যের সাধনাই করি। দেহ মিথ্যে হয়ে যায়। কামনা বাসনা মুছে যায়। শুধু জেগে থাকে প্রজ্ঞা।  প্রজ্ঞায় স্থির হয়ে মহাচৈতনেই স্থিত হয়ে পরি। বেশ নিরাপদ লাগে, মৃত্যৃভয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটা মনে এলো। কি আশ্চর্য সুন্দর আর সত্য।



পথে এবার নামো সাথী,পথেই হবে পথ চেনা!

আমার রোববারের রুটিন যারা জানেন, তারা আমার পথের রুটিনও জানেন। বেলেঘাটায় সুভাষ সরোবরের চারপাশে ৫/৭ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করে ফেরার পথে বাটা মাছ কিনে ফিরে আসা।  ঝুলিতে অবশ্য রসে টইটম্বুর জিলিপিও থাকে। কারণ,  ভালো চাই কি সাথ, মিঠা মিঠা জিলিপি মেরা বহুত মনপসন্দ। আর বাঁটা মাছের ঝাল সেটাও সহস্তেই করি। এ ব্যাপারে আমার ব্যাপক খ্যাতি আছে। সেটা খ্যাতির বিড়ম্বনাও হয়তো।


আজকেও রোববার।  আজও লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটার ব্যাপার ছিল। তবে সেটা কিঞ্চিৎ বিপ্লবের গন্ধ মাখা। কলেজ স্কোয়ার থেকে শুরু করে, ধর্মতলায় জমায়েত। আমাদের সংগঠনের ব্যাঙ্ক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও উদ্যোগের ব্যানারে। আমার অভিজ্ঞতায় বলে ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের  মাইনে/পেনশন বাঁড়ানোর কথা বললেই জনগণ বেজায় বক্রোক্তি করেন। সেইজন্যে বিশদে গেলাম না। তবে পেনশন আপডেশন ইত্যাদি কিছু কিছু না পাওয়া তো রয়েই গেছে। এর সাথে ছিল কন্ট্রাকচুয়াল কর্মীদের অনেক বঞ্চনার সুদীর্ঘ তালিকা। সেসবের গভীরে যাচ্ছি না। এরাই ছিল মিছিলের সিংহভাগ জুড়ে। 


এরকম পদযাত্রায় আগে যে যাইনি এমনটি নয়। কামদুনি কান্ডের বিরুদ্ধে মিছিলেও গেছি। সেও এক অনন্য অভিজ্ঞতা।  তবে আজকে লম্বা হেঁটে বেশ লাগলো।  কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা খুব কম রাস্তা তো নয়। আরো একটা অভিজ্ঞতা আজ হলো। আমায় দেখি অনেকেই চেনে।আমার পেনশনার চেনা অচেনা অনেকেই। এ নিশ্চয় ফেসবুকের কেরামতি।  বেশ ভালো লাগলো  তাদের সাথে একসাথে ধর্মতলার ট্রাম গুমটিতে দাঁড়িয়ে চা খেতে। 


ফেরার পথে আবার লং মার্চ। এবার এটা একান্তই আমার নিজস্ব। আমার এক গোপন ইচ্ছের সাকার রুপ দিতে। ধর্মতলা থেকে জানবাজার। জানবাজার  তো চেনেন। সেই জানবাজার যেখানে রাণী রাসমণীর বাড়ি। পুরনো কলকাতার ব্যক্তিত্বময়ী এক নারী। যিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্টা করেন। বাংলার রেঁনেসার সেই যুগে নিজ গুণে আলোকিত করেছেন, নতুন বাঙলার মঞ্চ। সেই রাণী রাসমণির বাড়ীর ঠিক পেছনেই এই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। আইকনিক পাইস হোটেল। বহুদিনের ইচ্ছে আসার। আজ এই লং মার্চের আশুফল অবশ্যই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমের মধ্যাহ্ন ভোজন। লাঞ্চ এইসব জায়গার খ্যাতির সাথে মেলে না। তাই মধ্যাহ্ন ভোজন। তা কি ছিল এই বহু প্রতিক্ষিত ভোজনে? সে তো দীর্ঘ মেনু, তা এই শর্মার কম্ম নয় জব্দ করার। নিয়েছিলাম মুসুরের ডাল, আলু ভাজা, ভেটকী মাছের কাটাচচ্চড়ি আর জাম্বো পাবদা। ভাতের পাহাড় আর পাবদা মাছের সাইজ দেখে কান্না পাচ্ছিল। এই পেটরোগা বামুনের সাধ্যি কি একে জব্দ করার। ধীরে সুস্থে তাও কিছুটা বশে এল। বহুদিনের বাসনা পূর্ণ হলো। রসনাও তৃপ্ত হলো। আর কোন ক্ষেদ রইলো না। এবার পেনশনটা আপডেশন হলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। জীবনে আর কিছু চাওয়ার রইবে না। পুরুর মতো হৃত যৌবন আর ফেরৎ চাইব না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।।

ফেরাটা আর পায়ে হেঁটে নয়। জ্যোতির সামনে থেকে পেয়ে গেলাম এসি ট্রাম। ভাড়া মাত্রই ২০ টাকা।  জানলার ধারে পুরনো কলকাতা দেখতে দেখতে ফিরে চললাম।  আমার সাথে আপনারাও দেখুন সেই পুরনো বিবর্ণ মনকাড়া কলকাতা সেই পথ ধরে। যে পথ ধরে একদিন চলেছেন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আরো না কতো কতো সব আলোক পুরুষেরা। আপনারাও চলুন আমার সাথে সেই পথ ধরেই।